হাসপাতালের ভেতরে শয্যা না পেয়ে বাইরে রোগীদের অবস্থান

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে অন্যান্য রোগীদের। স্বাভাবিক সময়ে শয্যার বাইরে অতিরিক্ত রোগী হাসপাতালে জায়গা পেলেও করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বিবেচনায় অতিরিক্ত রোগীদের জায়গা হচ্ছে না হাসপাতালের ভেতর। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্যানসার রোগীদের অবস্থান নিতে হচ্ছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের গেট সংলগ্ন নিচের খোলা জায়গায়।

রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, হাসপাতালের ভেতরে সিট না পাওয়ায় বাইরে থেকেই চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। করোনার কারণে কয়েকদিন পরপর লকডাউন দেওয়া, আবার হাসপাতালের ভেতরে রোগী ভর্তি নেওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু আমাদের তো নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হবে। এ অবস্থায় সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ১০০০/১২০০ রোগী আসেন। তাদের মধ্যে ওয়ার্ড থেকে পাঠানো শয্যা খালির তালিকা অনুযায়ী রোগী ভর্তি করা হয়। বাকিরা চিকিৎসার প্রয়োজনে বাইরেই অবস্থান করে। যেহেতু করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিও খারাপের দিকে, আমাদেরকে তো অন্যান্য রোগীদের সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে।

হাসপাতালটিতে সরেজমিন দেখা গেছে, বিভাগীয় পর্যায়ে এখনও বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি না হওয়ায় রোগীদের ঢল নামে রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে। তবে দেশের ২৭ ধরনের ক্যানসার রোগীদের জন্য এখানে রয়েছে মাত্র  ৩০০ শয্যার হাসপাতাল। এতে চিকিৎসার নাগাল পেতে যে সময় লাগছে তার আগেই ক্যানসার ছড়িয়ে যাচ্ছে ভুক্তভোগীর শরীরে।

জানসু বেপারী, শরীয়তপুরের জাজিরা থানার বাসিন্দা। চার মাস ধরে ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার স্ত্রী বলেন, স্বামীর পেটের ভেতরে টিউমার হয়েছিল, পরে সেখান থেকেই ক্যানসার হয়। প্রথমত মিটফোর্ড হাসপাতালে দুই মাস ভর্তি থাকার পর সেখানে অপারেশন করে তারা ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে রেফার্ড করে। চারমাস ধরে আমরা এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। কখনও হাসপাতালে সিট পেয়েছি, আর কখনও বাইরে থেকেই নিয়মিত ডাক্তার দেখানো কেমোথ্যারাপি দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, হাসপাতালে কেমোথ্যারাপি দেওয়ার পর থেকে তার মাথায়ও সমস্যা হচ্ছে। ঠিকমতো সবাইকে চিনতে পারছে না, কথা বলছে না। এই অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রেখে তার নিয়মিত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু ভেতরে জায়গা না হওয়ায় বাইরে অবস্থান নিয়েই চিকিৎসা করাতে হচ্ছে।

ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলা থেকে স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে এসেছেন তারা মিয়া। স্ত্রীর লিভার, গলায় ও খাদ্যনালীতে ক্যানসার ধরা পড়েছে। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, তিন বছর ধরে তিনি ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে দশ লাখের বেশি টাকা খরচ হয়েছে। এখনও নিয়মিত কেমোথ্যারাপি দিতে হচ্ছে।

তারা মিয়া বলেন, হাসপাতালের ভেতরে সিটের জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু না পেয়ে বাধ্য হয়েই বাইরে অবস্থান নিয়েছি। ২২টির মতো কেমোথ্যারাপি দিয়েও এখনও কোনো উন্নতি দেখছি না।

হাসপাতালের শয্যা ও রোগীদের বাইরে অবস্থান প্রসঙ্গে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক ডা. কাজী মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা মাত্র তিনশ। কিন্তু প্রতিনিয়ত রোগী আসে এক হাজারের বেশি। এতো রোগী আমরা কোথায় জায়গা দেব? এদিকে দেশে করোনা সংক্রমণ চলছে, এই অবস্থায় ভেতরে অতিরিক্ত রোগী রেখে আমরাও তো কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না।’

দেশে ক্যানসার নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ক্যানসার সম্পর্কিত অনলাইন ডাটাবেজ গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে ৯১ হাজারের বেশি মানুষই মারা যান।

এদিকে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক বলছেন প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। ডা. কাজী মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ। তাদের মধ্যে চিকিৎসা নিতে পারছেন মাত্র ৫০ হাজারের মতো।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে আছে ক্যানসার। সবশেষ ২০১৮ সালের হিসেবে পৃথিবীতে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে ৯৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতি বছর নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন তিন লাখ মানুষ। প্রতি ছয় জনে একজনের মৃত্যু হচ্ছে এই ক্যানসারের কারণে।

সংস্থাটি বলছে, সঠিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে বছরে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। যদিও পৃথিবীতে যত মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছে তার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

টিআই/জেডএস