স্ট্রোকের বিষয়ে কম-বেশি আমরা সবাই জানি। স্ট্রোক একটি প্রাগৈতিহাসিক রোগ। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ থেকে প্রাচীন মেসোপটেমীয় ও পারস্য সভ্যতায় স্ট্রোকের বর্ণনা পাওয়া যায়। স্ট্রোকে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। তাদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ স্ট্রোকের শিকার হন। এর মধ্যে পাঁচ মিলিয়ন মারা যান এবং আরও পাঁচ মিলিয়ন স্থায়ীভাবে অক্ষম বা প্যারালাইসিসের সম্মুখীন হন। অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে।

স্ট্রোক কী?

স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। স্ট্রোককে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় সেরেব্রো ভাস্কুলার এক্সিডেন্ট বা মস্তিষ্কের রক্তনালীর দুর্ঘটনা। মগজের রক্ত সরবরাহ কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে রক্তের অভাবে মগজের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এটাই স্ট্রোক।

স্ট্রোকের প্রকারভেদ:

স্ট্রোক দুই ধরনের- ১. ইশকেমিক স্ট্রোক ২. হেমোরেজিক স্ট্রোক

১. যখন মস্তিষ্কের রক্তনালীতে কোনো কিছু জমাট বাঁধে, যার ফলে রক্তনালিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং মস্তিষ্কের আক্রান্ত স্নায়ু কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়, তখন একে ইশকেমিক স্ট্রোক বলে। ৮৫ ভাগ স্ট্রোকই ইশকেমিক স্ট্রোক।

২. যখন মস্তিষ্কের ছোট ছোট রক্তনালিকা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হয়, তখন মস্তিষ্কে চাপ বাড়ে এবং অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো মারা যায়, যাকে বলা হয় হেমোরেজিক স্ট্রোক।

কেন স্ট্রোক হয়?

স্ট্রোকের বেশকিছু কারণ রয়েছে।

অপরিবর্তনশীল কারণ: বয়স বাড়ার সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হয়। বংশগত কারণ, পুরনো হার্টের রোগী বা রক্তনালীর রোগীদের ঝুঁকি বেশি।

পরিবর্তনশীল কারণ: উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তনালীতে চর্বি জমে যাওয়া, ধূমপান, জর্দা, তামাক জাতীয় দ্রব্য সেবন, স্থূলতা, রক্ত জমাট বাঁধার উপাদানের অভাব, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন ইত্যাদি।

স্ট্রোক বুঝবেন কীভাবে:

*হঠাৎ শরীরের একদিক দুর্বল বা অবশ হয়ে যাওয়া

* মুখের দিকে বেঁকে যাওয়া

* কথা বন্ধ বা জড়িয়ে যাওয়া

* দেখতে অসুবিধা হওয়া কিংবা কোনো জিনিস দুটি করে দেখা

* অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত মাথা ব্যথা ও বমি হওয়া

* খিঁচুনি হওয়া

স্ট্রোকের রোগী চিহ্নিত করতে সহজ একটি উপায় অবলম্বন করতে পারি:

F-Face: রোগীকে হাসতে বলুন। লক্ষ্য করুন মুখের এক পাশ ঝুলে আছে কি?

A-Arms: রোগীকে উভয় বাহু বাড়াতে বলুন। কোন বাহু কি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে?

S-Speech: রোগীকে একটি সাধারণ বাক্যাংশ পুনরাবৃত্তি করতে বলুন। কথা অস্পষ্ট কি না?

T-Time: আপনি যদি এ লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি দেখতে পান, তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন

স্ট্রোক হয়েছে কি না নির্ধারণে যেসব পরীক্ষা :

* মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান (স্ট্রোকের ধরন নির্ণয়ের জন্য)

* মস্তিষ্কের এমআরআই (ইশকেমিক স্ট্রোক জনিত কারণ নির্ণয়ের জন্য)

স্ট্রোকের চিকিৎসা এবং গোল্ডেন আওয়ার:

টাইম ইজ ব্রেন। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। টাকার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্ক ঠিক রাখা। স্ট্রোকের পর যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে যেতে পারে আপনার মূল্যবান জীবন। স্ট্রোক হওয়ার পর সাড়ে ৪ ঘণ্টা হলো গোল্ডেন আওয়ার। এসময়ের মধ্যে মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীর রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক করে দিতে পারলে স্ট্রোক পরবর্তী ক্ষতিগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। চিকিৎসার প্রথম লক্ষ্য হলো- হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

ইশকেমিক স্ট্রোক: ইশকেমিক স্ট্রোক ব্যবস্থাপনার জন্য থ্রম্বোলাইসিস একটি পছন্দসই থেরাপি। তবে এটি স্ট্রোক পরবর্তী প্রথম সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কার্যকর। ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ক্লটগুলো সরানো সম্ভব।

হেমোরেজিক স্ট্রোক: ঔষধের মাধ্যমে পরবর্তী রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মস্তিষ্কের জমে থাকা রক্ত বের করা এবং মস্তিষ্কের চাপ কমানো হেমোরেজিক স্ট্রোকের প্রচলিত চিকিৎসা।

স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নিউরোসার্জারি বিভাগে চালু হয়েছে স্ট্রোক ইউনিট। যেখানে দ্রুত স্ট্রোক রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। মিনিম্যালী ইনভ্যাসিভ সার্জারিসহ স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষার্থে সব ধরনের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।

স্ট্রোক পরবর্তী চিকিৎসা:

স্ট্রোকের পরবর্তী সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ফিজিক্যাল, স্পিচ এবং অকুপেশনাল থেরাপি গ্রহণের মাধ্যমে অনেকেই পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।

স্ট্রোক মানেই মৃত্যু নয়, প্রয়োজন তাৎক্ষণিক চিকিৎসা:

বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে- ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সময় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। স্ট্রোক হলে প্রতি মিনিটে মস্তিষ্কের ১৯ লাখ স্নায়ু কোষের আনুমানিক ১৪০ কোটি স্নায়ুর মধ্যবর্তী যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যায় এবং ১২ কিলোমিটার স্নায়ু নষ্ট হয়ে যায়। তবে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে মস্তিষ্কের ক্ষতি ও মৃত্যুর হার কমানো যায়।

স্ট্রোক প্রতিরোধ এবং বিশ্ব স্ট্রোক দিবস:

স্ট্রোক প্রতিরোধ যোগ্য রোগ। চিকিৎসার চেয়ে এ রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আমাদের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং চর্বিযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড পরিহার করা। পাশাপাশি ধূমপান ও তামাক পাতা বর্জন করা এবং নিয়মিত শাকসবজি গ্রহণ করা উচিত। তাছাড়া নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএসও) দিবসটি পালন শুরু করে। তখন থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হচ্ছে। আসুন আমরা স্ট্রোক সম্পর্কে সচেতন হই এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করি।

ডা. মোহাম্মদ নজরুল হোসেন
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
নিউরোসার্জারি বিভাগ
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইন্সটিটিউট