স্ট্রোকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। মস্তিষ্কের রক্তনালীর জটিলতার কারণে হঠাৎ করেই চলার শক্তি হারিয়ে যাওয়া ও অচেতন হওয়াকে সাধারণত আমরা স্ট্রোক বলি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের ভীতি বাড়তে থাকে। তবে তরুণদের বা চল্লিশের কম বয়স্কদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি।

প্রতি বছরের মতো এবারও ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে ‘মুহূর্ত বাঁচাতে পারে সজীবতা’ এবং ‘অমূল্য সময়’ স্লোগান দুইটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে করা হবে সচেতনতা ক্যাম্পেইন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শতকরা ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়ম মাফিক জীবনযাপন করলে। আশার আলো হলো, দ্রুত নির্ণয় করতে পারলে ৭০ ভাগের বেশি রোগী এর মারাত্মক ছোবল থেকে রেহাই পেতে পারেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, দেশেই এখন স্ট্রোকের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক নিউরো ক্যাথল্যাব,  ইন্টারভেশন ও অপারেশন থিয়েটার। যা কমপ্রিহেনসিভ এপ্রোচ বা হাইব্রিড পদ্ধতি নামে জনপ্রিয়।

স্ট্রোক কি?

মস্তিষ্কের রক্তনালী বাধাপ্রাপ্ত হলে কিংবা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হলে স্নায়ুকোষে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। এটিই স্ট্রোক বা ব্রেইন অ্যাটাক!

রক্তনালীতে চর্বি বা থ্রম্বাস জমে সরু হয়ে যে স্ট্রোক হয় সেটি ইসকেমিক স্ট্রোক। আর রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণ হলে সেটিকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলে। দ্বিতীয়টির মৃত্যু ঝুঁকি বেশি হলেও আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের জরিপ অনুযায়ী,  ৮৭ ভাগ স্ট্রোকই ইসকেমিক ধরনের হয়ে থাকে।

কিভাবে বুঝবেন স্ট্রোক হয়েছে?

যদি আচমকা হাত, পা, বা শরীরের কোনো এক দিক অবশ লাগে বা চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধা হয়, কিংবা তীব্র মাথা ব্যথা হয় ও হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান– এমন কোনো একটি লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। এগুলো বি ফাস্ট ( ব্যালেন্স, আই, ফেইস, আর্ম, স্পীচ ও টাইম) হিসেবে পরিচিত।

হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা- শ্বাস প্রশ্বাস ও রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিতের পর দ্রুত মাথার সিটি স্ক্যান করে স্ট্রোকের ধরণ নির্ণয় করবেন চিকিৎসক গণ। রোগীর স্বজনদের উচিত এ সময় রোগীকে মুখে কিছু না খাওয়ানোর চেষ্টা করা। রোগীকে এক দিকে কাত করে, বালিশ মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে। ওষুধ ও পথ্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে নাকে নল দিতে হতে পারে।

তাৎক্ষণিক  চিকিৎসার ‘সুবর্ণ সময়’

সিটি স্ক্যানে ইসকেমিক স্ট্রোক নির্ণয় হলে এন্টিপ্লেটলেট ও এন্টিকোয়াগুলেন্ট ওষুধের পাশাপাশি সম্প্রতি “অ্যালটিপ্লেজ” নামক থ্রোম্বোলাইটিক থেরাপি যা দ্রুত জমাট বাধা রক্ত গলিয়ে দেয়- প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে চার ঘণ্টা পর্যন্ত মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বা প্যারালাইসিস রোধ করা সম্ভব। এটি স্ট্রোক চিকিৎসার গোল্ডেন আওয়ার বা সুবর্ণ ঘণ্টা নামে জনপ্রিয়। পড়ে এমআরআই ইমেজের ওপর ভিত্তি করে ৬-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময়ে এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জনরা না কেটে সরু নলের সহায়তায় জমাট বাধা রক্ত বা চর্বির দলা বের করে আনা যায়।

এছাড়াও গলায় অবস্থিত ক্যারোটিড ধমনী বেশি সংকুচিত হয়ে গেলে রিট্রাইভার মেশিনের সহায়তায় স্টেনটিং ও বেলুন এনজিওপ্লাস্টি করে মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন পুনরায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। উন্নত বিশ্বে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত মেকানিক্যাল থ্রম্বেক্টমির চেষ্টা করা হয়- যা এখন ঢাকাতেই সম্ভব। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, স্ট্রোকের পর প্রতি মিনিটে ২ মিলিয়ন স্নায়ু কোষ চিরতরে মারা যায়।

হেমরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক হলে থ্রোম্বোলাইটিক ওষুধ প্রয়োগে আরও বিপত্তি হবে। রক্তক্ষরণের কারণ নির্ণয় করে এন্ডোভাস্কুলার নিউরোসার্জনদের দক্ষ টিম এনিউরিজম (রক্তনালীর ফোস্কা) ক্লিপিং ও কয়েলিং করতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে শিশু ও কিশোরদের বিরল রক্তনালীর জন্মগত ত্রুটিপূর্ণ গঠন দেখা দিলে তা স্ট্রোকের মত উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। এসব জটিল ক্ষেত্রে একই সংগে ক্যাথল্যাবে এন্ডোভাস্কুলার অ্যাপ্রোচের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করে পরে মাথার খুলি হাইস্পিড ড্রিলের মাধ্যমে কেটে বিকৃত রক্তনালী সম্পূর্ণরূপে অপসারণ সম্ভব। নতুন এই দ্বৈত শল্যচিকিৎসা পদ্ধতিকে হাইব্রিড পদ্ধতি বলা হয়। বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগে এই সেবা সম্প্রতি চালু হয়েছে।

তাৎক্ষনিক চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য মৃত্যু ঝুঁকি কমানোর। পাশাপাশি রোগীর কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা, প্যারালাইসিস প্রতিরোধ এবং পরবর্তী স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করা। সময় মতো যথাযথ চিকিৎসা পেলে শতকরা ৩০ ভাগ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কর্মময় জীবনে ফিরে যেতে পারবেন।

স্ট্রোক হওয়ার প্রধান কারণ

১. অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ : ৫০ শতাংশ স্ট্রোক রোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকে। যারা নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করেন না তাদের স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা ৫ গুণ বেশি।

২. অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস

৩. ধূমপানের অভ্যাস

৪. নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাস

৫. হার্টের অসুখ-রিউমেটিক ভাল্বুলার ডিজিস, অ্যারিদমিয়া

৬. স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা

৭. দিনভর বসে কাজ করা এবং কায়িক শ্রম না করা

৮. ফাস্ট ফুড বেশি খেলে (বাচ্চাদের ও তরুণদের স্ট্রোকের জন্য দায়ী)

৯. রক্তে কোলেস্টেরল চর্বি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে

বিরল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে– রক্তনালীর গঠনগত ত্রুটি, রক্তরোগ যেমন- হাইপারকোয়াগুলোপ্যাথি, কোলাজেন সমস্যাগুলো অন্যতম।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ইসকেমিক স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। কারণ ডায়াবেটিস রোগীদের Atherosclerosis বেশি হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি। শরীর এই অতিরিক্ত শর্করাকে Lipogenesis প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্নেহপদার্থ/চর্বি (lipid/fat) এ পরিণত করে। এই ফ্যাট জমতে থাকে রক্তবাহের ভেতরে। ক্যাথল্যাবে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ক্যারোটড অ্যাথেরেক্টমি বা Endartarectomy হরহামেশাই করা হচ্ছে যা, মেজর স্ট্রোক ও নিশ্চিত পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচাতে পারে।

স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে করণীয়

• ওজন কমাতে সুষম খাবারেই ভরসা রাখতে হবে। দামি নয়, দেশি ও সহজলভ্য খাবার দিয়ে প্লেট সাজাতে হবে।

• ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি ও দেশি ফল।

• সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধা-ঘণ্টা করে দ্রুত হাঁটতে হবে বা ২ দিন ১৫০ মিনিট জগিং করা যেতে পারে।

• ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করা।

• প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।

• ব্লাড প্রেশার আর সুগার বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে হবে।

•শরীর চর্চার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন অত্যাধিক পরিশ্রমসাধ্য বা ক্লান্তিকর না হয়।

মাইল্ড স্ট্রোক (TIA) : সতর্ক সংকেত

মাইল্ড স্ট্রোক হলো স্ট্রোকের মতো কিছু উপসর্গ, যা কয়েক মিনিটব্যাপী থাকে। চিকিৎসা না নিলে মাইল্ডস্ট্রোক আক্রান্ত হওয়া রোগীদের প্রতি ১০ জনে ১ জন তিনমাসের মধ্যে মেজর স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এক্ষেত্রে একজন স্ট্রোক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চেক আপ করা প্রয়োজন।

এমএইচএস