ইউক্রেনে রাশিয়ার অত্যন্ত বিপজ্জনক সামরিক উপস্থিতির চিত্র দেখা গেছে স্যাটেলাইটে। ৪০ মাইলের দীর্ঘ একটি সামরিক বহর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উত্তর দিক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই ছবিতে এই সামরিক বহরের পথের আশপাশের বাড়িঘর, ভবন জ্বলতে দেখা গেছে। যে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে রাশিয়া তড়িৎগতিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করেছে, সেটি এখন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। তার মাঝে নতুন করে শত শত সামরিক যান নিয়ে কিয়েভের দিকে রুশ সৈন্যদের এই বহর নিয়েও নানা ধরনের গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, রাশিয়া হয়তো তার আগ্রাসনের কৌশল পাল্টে ফেলেছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যে সামরিক বহর কিয়েভের দিকে এগোচ্ছে, তাতে সামরিক রসদ সরবরাহ ও সাঁজোয়া যান রয়েছে। রাজধানী ঘেরাও এবং পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা অথবা পুরোমাত্রার আক্রমণ চালানোর জন্য এই সামরিক বহর ব্যবহার করা হতে পারে।

লন্ডনের শীর্ষস্থানীয় পলিসি ইনস্টিটিউট চ্যাথাম হাউসের রুশ যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ বুলেগু নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, আমরা যা দেখছি তা মূলত দ্বিতীয় ধাপের কৌশল। এটি অত্যন্ত নৃশংস এবং অনিয়ন্ত্রিত যুদ্ধের দিকে গতি বদল। যা ইউক্রেনে পুরো পরিস্থিতিকে অনেক বেসামরিক হতাহত এবং রক্তাক্ত যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে।

ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সক্ষমতা রয়েছে; যা রুশ সৈন্যদের বহরে আঘাত হানতে সক্ষম। তবে এর ক্ষমতা সীমিত। এত দীর্ঘ বহরকে লক্ষ্যবস্তু করা হলে তা ইউক্রেনের সৈন্যদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। রাশিয়াকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্ররোচিত করবে।

রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর শত শত গাড়ি ছুটছে কিয়েভের দিকে

আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ক্রিটিক্যাল থ্রেটস প্রজেক্টের পরিচালক ফ্রেডরিক ডব্লিউ কাগান বলেন, আকাশ থেকে এই বহরে হামলা চালানোর আগে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীকে তাদের বিমান বাহিনীর একেবারে সীমিত শক্তির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা এবং অত্যন্ত কঠিন লক্ষ্যের পেছনে ছোটার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্ভবত আক্রমণাত্মকভাবেই এই বহরের সুরক্ষা দিচ্ছে।

কিয়েভে প্রবেশ না করা পর্যন্ত ইউক্রেনের কমান্ডাররা হয়তো সাঁজোয়া যান মোতায়েনের অপেক্ষা করছেন। যেখানে শহরের রাস্তায় নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকায় তাদের আরও সহজে ধ্বংস করা যেতে পারে। কিয়েভে সৈন্যদের আত্মগোপনে যাওয়ার প্রচুর জায়গা রয়েছে এবং সেখানে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপকারী সৈন্যদের সুরক্ষাও প্রদান করা যেতে পারে।

রাশিয়ার ওই সামরিক বহরের যথাযথ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগাম ধারণা করা কঠিন বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, কিয়েভকে দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর জন্যও ওই বহরকে ব্যবহার করা হতে পারে। রাশিয়া প্রাথমিক কৌশল শেষে দ্বিতীয় স্তরের কৌশলে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রাথমিক কৌশল অনুযায়ী, ক্রেমলিনের নেতারা ভুলভাবে ধরে নিয়েছিলেন যে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অত্যন্ত দক্ষ রুশ সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে দ্রুত পরাজয়ের সম্মুখীন হবে। এছাড়া বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা লড়াই ছাড়াই রাশিয়ার সৈন্যরা দ্রুত বড় বড় শহরগুলো দখল করতে পারবে। কিন্তু ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী এবং হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া নাগরিকদের কঠোর প্রতিরোধের মুখে প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অভিযান।

ইউক্রেনের সৈন্যদের গোলার আঘাতে পুড়ছে রুশ সাঁজোয়া যান। সামনে পড়ে আছে রুশ সৈন্যের নিথর দেহ

রাশিয়ার সেই সামরিক বহর এখন কোথায় সেটি জানা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ আকাশে প্রচণ্ড মেঘ থাকায় এই বহরের চিত্র স্যাটেলাইটে পরিষ্কারভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া বহরের পথের বাড়িঘরে আগুন দেখা গেলেও আসলে সেখানে হামলা হয়েছে কিনা, তাও স্পষ্ট নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি স্যাটেলাইট প্রযুক্তি কোম্পানি ম্যাক্সারের প্রকাশিত চিত্রে দেখা যায়, ইউক্রেনের আন্তোনোভ বিমানবন্দর থেকে উত্তরের প্রিবিরস্ক গ্রামের দিকে প্রায় ৪০ মাইল দীর্ঘ একটি রুশ সামরিক বহর এগিয়ে আসছে। এতে সৈন্যদের জন্য খাবার, যানবাহনে জ্বালানি সরবরাহের গাড়ি রয়েছে। তবে যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ বুলেগুর পর্যালোচনা অনুযায়ী, রাশিয়ার এই সামরিক বহরে মাইলের পর মাইল শুধু ভারী গোলাবারুদ ও কামান রয়েছে। 

আর এই বহরটি অবিচ্ছিন্ন নয়। কিছু যানবাহনের একটি অপরটি থেকে অনেক দূরে রয়েছে। কিছু কিছু এলাকার সড়কে দুই তিন সারিতে পাশাপাশি চলতেও দেখা গেছে। ক্রিটিক্যাল থ্রেটস প্রজেক্টের পরিচালক ফ্রেডরিক ডব্লিউ কাগান বলেছেন, এটি লক্ষণীয় যে, সামরিক বহরটি পুরোপুরি অ্যাটাক যানবাহন নিয়ে গঠিত নয়।

এর আগে, মঙ্গলবার পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রুশ বাহিনী জ্বালানি, খাবার এবং সামরিক যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশের সংকটে ভুগছে। কাগান বলেছেন, সামরিক সরঞ্জামের সংকট এড়াতে ওই বহরে বেশ কয়েকটি ট্রাকে সম্ভবত প্রয়োজনীয় রসদ রয়েছে।

ক্রিটিক্যাল থ্রেটস প্রজেক্টের এই পরিচালক বলেন, রাশিয়া যখন প্রাথমিকভাবে সৈন্যদের সীমান্তে মোতায়েন করেছিল— বিশেষ করে বেলারুশ সীমান্তে এগিয়ে যাওয়ার আগে, তখন আক্রমণ শুরুর সাথে সাথে সাধারণত যে ধরনের ঘাঁটি প্রস্তুত রাখতে হয়, সেটি করেছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, রাশিয়া অনুপ্রবেশের পরও কেন দ্রুত রাজধানী দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা বুঝতে সহায়তা করছে এটি।

কিয়েভের দক্ষিণের বুচা শহরের সড়কে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর যানবাহনের ধ্বংসাবশেষ

তবে আক্রমণকারী বাহিনীর জন্য এ ধরনের সামরিক সরঞ্জামের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কাগানের মতে, প্রেসিডেন্ট পুতিন কয়েক মাস ধরে এই আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তারপর কয়েক দিনের আগ্রাসন এবং সামরিক অভিযানে গিয়ে এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়াটা অস্বাভাবিকই।

‘এতে বোঝা যাচ্ছে, এই আক্রমণ আসলে দুর্বল পরিকল্পনার অংশ এবং দুর্বলভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। যে কারণে এটি ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। দুর্বল পরিকল্পনা যেভাবে সমস্যাটি তৈরি করেছে, সেটি মোকাবিলায় সেভাবে ঝাঁকুনিও খাচ্ছে রুশ বাহিনী।’

রাশিয়ার উচ্চতর সামরিক সক্ষমতা এবং সম্পদ থাকা সত্ত্বেও কিয়েভের বাইরে অস্ত্রশস্ত্রের বহর নিয়ে ছোটায় যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে বিস্মৃত উপসংহারেও পৌঁছানো যাচ্ছে না। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকরা যেভাবে অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন তা নিয়ে ‘আমি বাজি ধরতে পারি’ বলে মন্তব্য করেছেন কাগান।

এসএস