অভ্যুত্থানের পক্ষে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সাফাই
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং সরকারকে উৎখাতের বিষয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিং অং হ্লেইং। সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দেওয়া টেলিভিশন ভাষণে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন তিনি।
ভাষণে গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছিল বলে দাবি করেছেন অভ্যুত্থানকারী এই সেনাপ্রধান। ওই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয় অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)।
বিজ্ঞাপন
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, অভ্যুত্থানের পর দেওয়া জেনারেল হ্লেইংয়ের প্রথম ভাষণে মূলত দুটি বিষয় ছিল। তার ভাষণের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ছিল অভ্যুত্থানের পক্ষে কারণ বা যুক্তি তুলে ধরা। তবে সেই তুলনায় অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীদের প্রতি তার হুমকি ছিল তুলনামূলক কম।
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান বলেন, নভেম্বরের নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকায় জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন। এমনকি ভোটের আগে তারা (নির্বাচন কমিশন) সুষ্ঠু প্রচারণার বিষয়টিও অনুমোদন করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
অবশ্য নির্বাচনে কোনো অনিয়ম বা কারচুপি হয়নি বলে আগেই জানিয়েছিল দেশটির নির্বাচন কমিশন।
সামরিক পোশাক পরে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে জেনারেল হ্লেইং নতুন নির্বাচন আয়োজন এবং এতে বিজয়ীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের’ মাধ্যমে পরিবর্তিত একটি কমিশন নতুন নির্বাচন আয়োজন করবে।
তিনি আরও বলেন, পূর্বের ৪৯ বছরের সামরিক শাসনের তুলনায় তার শাসন হবে ‘আলাদা’। তার শাসনের মাধ্যমে মিয়ানমার ‘একটি সত্যিকারের এবং সুশৃঙ্খল গণতন্ত্র’ অর্জন করতে পারবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ, অং সান সু চির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোমবার টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভে নামে মিয়ানমারের মানুষ। এছাড়া রাজপথে বিক্ষোভের পাশাপাশি কর্মজীবীরা দেশব্যাপী ধর্মঘটে নামায় আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা।
স্বাভাবিক ভাবেই অভ্যুত্থানকারী শীর্ষ এই সামরিক কমান্ডার টানা তিন দিন ধরে বিক্ষোভ চালিয়ে আসা মানুষের উদ্দেশে কী বলেন; সেটা শুনতেই অনেকে মুখিয়ে ছিলেন। তবে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ করে সরাসরি কোনো হুমকি দেননি জেনারেল হ্লেইং। শুধু এটাই বলেছেন যে, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
এছাড়া আবেগের বশবর্তী হয়ে আন্দোলন না করে বাস্তব ও সত্য ঘটনা জেনে সেই অনুযায়ী চলতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর মান্দালাইয়ের বেশ কিছু এলাকায় সোমবার মার্শাল ল জারি করেছে সামরিক জান্তা সরকার। একইসঙ্গে মিয়ানমারজুড়ে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ আরও জোরালো হওয়ার পর যাতে আর কোনো বিক্ষোভ না হয় এ ব্যাপারেও হুঁশিয়ার করে সামরিক বাহিনী।
বিবিসি জানিয়েছে, দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালাইসহ দেশটির আরও বেশ কিছু স্থানে রাত ৮টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে। কারফিউ চলাকালীন একসঙ্গে পাঁচ জন বা এর বেশি মানুষের জড়ো হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মান্দালাইয়ের একটি উপশহর কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ‘পরবর্তী নোটিশ না দেওয়া পর্যন্ত নির্দেশ বলবৎ থাকবে।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কিছু মানুষ উদ্বেগজনক আচরণ করছে যা জনসাধারণ এবং আইন প্রয়োগের সুরক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জাতীয় আচরণ স্থিতিশীলতা, মানুষের সুরক্ষা, আইন প্রয়োগকারী এবং গ্রামগুলোর শান্তিপূর্ণ অস্তিত্বকে প্রভাবিত করতে পারে এবং দাঙ্গা সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণেই এই আদেশের মাধ্যমে জনসমাবেশ, জনসমক্ষে কথা বলা, যানবাহনের মাধ্যমে সমাবেশ করে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
এর আগে সোমবার দিনের আলো ফুটতেই রাজধানী নেপিদোর রাস্তায় জড়ো হন লাখো মানুষ। বিক্ষোভে তারা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদ এবং অং সান সু চির মুক্তি দাবি করেন। এছাড়া ইয়াঙ্গুন ও মান্দালাইসহ দেশের অন্য শহরগুলোতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ সোমবার বিক্ষোভে নামেন।
সোমবার বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানায়, রাজধানী নেপিদোতে জড়ো হওয়া লাখ লাখ মানুষের ওপর পুলিশ জল কামান ব্যবহার করেছে বলে একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে। ফুটেজে দেখা যায়, সু চির মুক্তির দাবিতে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের একটি অংশের ওপর হঠাৎই জলকামান ব্যবহার শুরু করে পুলিশ। এতে কয়েকজন আহত হন।
মিয়ানমারে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হলেও জান্তা সরকার এখনো সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগের পথে হাঁটেনি। বিক্ষোভ নিয়ে সামরিক বাহিনী হুঁশিয়ারও করে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে মিয়ানমারের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটায়। গ্রেপ্তার করা হয় বিপুল ভোটে নির্বাচিত মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিসহ তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের। এতে করে দীর্ঘদিন পর দেশটিতে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবার থমকে গেছে। এরপর শুরু হয়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ।
সূত্র: বিবিসি
টিএম