সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ‘পুনরুদ্ধারে’ দেশটির ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের পরিবর্তে তার পিতা এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রপ্রধান বাদশাহ সালমানকে গুরুত্ব দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন।

সম্প্রতি এ বিষয়টি সাংবাদিকদের অবহিত করেছেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণলয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এই ঘোষণার মাধ্যমে সৌদি যুবরাজকে একপ্রকার ‘চপেটাঘাত’ করেছে বাইডেন প্রশাসন।

মঙ্গলবার জেন সাকি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো অবাধ ও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিচ্ছি। সৌদি বাদশাহ সালমানের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন আমাদের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সমমর্যাদাসম্পন্ন হচ্ছেন বাদশাহ সালমান এবং প্রেসিডেন্ট চাইছেন দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হোক।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ‍যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে জানান, সৌদি আরব বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের নতুন নীতি অনুযায়ী এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যোগাযোগ রাখবেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি বর্তমানে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ব যাকে ইতোমধ্যে সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো ‍নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের নতুন নীতিতে তার মর্যাদা খাটো করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে মোহাম্মদ বিন সালমানের গুরুত্ব বাড়তে থাকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে। দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম যে রাষ্ট্রে সফর করেছিলেন, সেটি ছিল সৌদি আরব। ২০১৭ সালের ওই সফরে সৌদি আরব সরকারকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তিতে সই করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রয় চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসে নিহত হন সাংবাদিক জামাল খাসোগি, যিনি সৌদি আরবের রাজনীতি ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কঠোর সমালোচক ছিলেন। সৌদি যুবরাজের নির্দেশেই খাসোগিকে হত্যা করা হয়- ওয়াশিংটনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে অভিযোগ তুললেও তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

এ বিষয়ে তখন মার্কিন কংগ্রেসে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তত্ত্বাবধানে তদন্তের দাবি উঠলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড ক্রুশনারের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রিবিষয়ক চুক্তির জের ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে সে যাত্রা বেঁচে যান বিন সালমান।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে সৌদি যুবরাজের গতিবিধি সম্পর্কে সচেতন, তা জানা গিয়েছিল শুরু থেকেই। দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেন বাইডেন। 

পাশাপাশি ইয়েমেনে শান্তি স্থাপনে দেশটি থেকে সৌদি সেনাদের প্রত্যাহারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সামনে আনেন এবং খাসোগি হত্যার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সিআইএকে নির্দেশ দেন। সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

এরপর সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে সর্বশেষ এই ঘোষণা এলো। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বিশেষ দূত অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, এর মাধ্যমে সৌদি যুবরাজকে কার্যত ‘চপোটাঘাত’ করেছে বাইডেন প্রশাসন।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সৌদি যুবরাজকে আগে থেকেই বেপরোয়া ও নির্মম বলে বিবেচনা করে আসছে বাইডেন প্রশাসন। সাম্প্রতিক এই ঘোষণার মাধ্যমে তাকে একপ্রকার চপোটাঘাত করা হলো। ‘

`যদিও বয়স এবং স্বাস্থ্যগত কারণে সৌদি বাদশাহ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থেকে বর্তমানে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু এই নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করল- যতদিন বাদশাহ জীবিত আছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন কার্যকর রয়েছে, ততদিন উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কেন্দ্রে আসার সম্ভাবনা সৌদি যুবরাজের নেই।’

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অপর সাবেক বিশেষ দূত এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সদস্য মার্টিন ইন্ডিক এ বিষয়ে বলেন, ‘এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আসলে সৌদি যুবরাজকে বলতে চাইছেন, যে মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা রয়েছে তার। এগুলো হলো- ইয়েমেনে সংঘাত বন্ধ করা, সৌদি আরবে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং ব্যাক্তিগত আচরণ পরিবর্তন।’

‘প্রেসিডেন্ট আন্তরিকভাবেই চান, সৌদি যুবরাজ নিজেকে পরিবর্তন করুন। যদ্দিন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের এই প্রত্যাশা পূরণ না হবে, ততদিন পর্যন্ত বাদশাহর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবেন তিনি।’

সূত্র: ব্লুমবার্গ

এসএমডব্লিউ