দুই দশকের বেশি সময় পর গান্ধী পরিবারের বাইরে নতুন সভাপতি পেল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল কংগ্রেস। প্রতিদ্বন্দ্বী শশী থারুরকে বিপুল ভোটে হারিয়ে দলটির সভাপতি হয়েছেন জ্যেষ্ঠ নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে।

দীর্ঘদিন পর ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের অনুষ্ঠিত প্রথম এই নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ বুধবার দলটির নেতৃত্ব নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়েছে, ৯ হাজার ৩৮৫ ভোটের মধ্যে মল্লিকার্জুন খাড়গে পেয়েছেন ৭ হাজার ৮৯৭ ভোট। প্রবীণ এই রাজনীতিকের প্রতিদ্বন্দ্বী শশী থারুর পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৭২ ভোট।

সেই হিসেবে থারুরের চেয়ে আটগুণ বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন খাড়গে। সোমবার এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়েছিল। তবে ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিলেন শশী থারুরের সমর্থকরা।

কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠিও দিয়েছিলেন তারা। সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘নির্বাচন পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুতর অনিয়ম আপনার নজরে আনতে চাই। সবাই দেখতে পেয়েছে, এই নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতা ও সততার অভাব রয়েছে।’

তবে বুধবার ফলাফল ঘোষণার পর তা মেনে নিয়েছেন শশী থারুর। এক টুইটবার্তায় মল্লিকার্জুন খাড়গের সাফল্যও কামনা করেছেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের এই জ্যেষ্ঠ নেতা।

টুইটবার্তায় থারুর বলেন, ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি হতে পারা অত্যন্ত সম্মান ও গৌরবের একটি ব্যাপার; এবং খাড়গেজি এই পদে সফল হবেন— এই কামনা করছি। আর ভারতজুড়ে কংগ্রেসের যেসব নেতাকর্মী আমার ওপর ভরসা রেখেছেন, তাদেরও আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’

কংগ্রেসের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা দ্য হিন্দুকে জানিয়েছেন, চলতি বছর দীপাবলী উৎসবের পর আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন মল্লিকার্জুন খাড়গে।

১৮৮৫ সালের ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। ব্রিটিশ ভারতের বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম এই সম্মেলনের আহ্বান ও আয়োজন করেছিলেন। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এই ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে।

ভারতের জনগণের দাবি দাওয়া ব্রিটেনের সরকারের সামনে তুলে ধরাই ছিল দলটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। পরে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেয় কংগ্রেস।

এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অপর রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাও একসময় কংগ্রেসের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ছিলেন।

১৩৭ বছরের পুরোনো এই দলটিতে গান্ধী পরিবারের আধিপত্য শুরু গত শতকের শুরু থেকেই, মতিলাল নেহেরুর মাধ্যমে। উত্তর প্রদেশের আগ্রা থেকে আসা এই আইনজীবী ও রাজনীতিক মতিলাল নেহেরু ১৯১৯ থেকে ১৯২০ এবং ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে কংগ্রেসের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তারপর ত্রিশের দশক থেকে কংগ্রেসে গুজরাটের আইনজীবী ও রাজনীতিক মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর প্রভাব বাড়তে থাকে। মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিতি পাওয়া এই নেতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। এ সময় তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট ও বিশ্বস্ত সহকারী ছিলেন মতিলাল নেহেরুর ছেলে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীও হন তিনি।

১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর পর দলের হাল ধরেন তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী। মূলত তারপর থেকেই নেহেরু পরিবারের সদস্যরা গান্ধী পরিবার নামে পরিচিতি পায়।

১৯৮৪ সালের অক্টোবর নিজের দেহরক্ষীদের হাতে ইন্দিরা গান্ধী খুন হওয়ার পর তার ছেলে রাজীব গান্ধী দলের নতুন সভপতির পদে আসেন। কিন্তু তিনিও ১৯৯১ সালে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন।

রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর কয়েক বছর কংগ্রেসের সভপতির পদে গান্ধী পরিবারের আর কেউ আসেননি। এই ধারায় দলটির সর্বশেষ সভাপতি ছিলেন সীতারাম কেশরী। ১৯৯৮ সালে রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী এ পদে আসার আগ পর্যন্ত দলের সভাপতি ছিলেন কেশরী।

বুধবার ৮০ বছর বয়স্ক মল্লিকার্জুন খাড়গের সভপতি হওয়ার মধ্যে দিয়ে দৃশ্যত আরও একবার কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বে গান্ধী পরিবারের আধিপত্যের অবসান ঘটল।

তবে কংগ্রেসের ভেতরের খবর, সোনিয়া গান্ধীর ‘একান্ত অনুগত’ খাড়গে দলের সভাপতি নির্বাচনের দৌড়ে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন। ফলে শীর্ষ পদে পরিবর্তন এলেও কংগ্রেসের নেতৃত্বের রাশ এখনও গান্ধী পরিবারের হাতেই রয়ে গেছে বলে বিশ্বাস ভারতের রাজনীতি বিশ্লেষকদের।

সূত্র: দ্য হিন্দু, রয়টার্স, আনন্দবাজার

এসএমডব্লিউ/এসএস