শ্রীলঙ্কার সরকার জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে মুসলিম নারীদের বোরকা নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে; তাতে দেশটির মুসলিমদের মাঝে ভয় এবং উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অনেকেই দেশটির সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বর্ণবাদী এজেন্ডা হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এর ফলে দেশজুড়ে বিভাজন তৈরির শঙ্কাও করছেন।

এর আগে, শনিবার শ্রীলঙ্কার জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী সারাথ উইরাসেকেরা বলেন, বোরকা নিষিদ্ধ করতে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য একটি নথিতে স্বাক্ষর করেছেন তিনি। বোরকা নিষিদ্ধের পাশাপাশি দেশটির সরকার এক হাজারের বেশি মাদরাসা বন্ধের পরিকল্পনা করেছে বলেও জানান তিনি।

দেশটিতে মাদরাসাগুলো জাতীয় শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে মন্তব্য করেন লঙ্কান এই মন্ত্রী। তবে শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিক সরকারের এমন সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে পারছেন না। অনেকেই শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন সরকারের এই পদক্ষেপকে। তবে এর মাধ্যমে দেশে বিভাজন তৈরি হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।

এটি একটি বর্ণবাদী এজেন্ডা। সরকার বৌদ্ধদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, তারা মুসলিমদের পেছনে পড়ে যাচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার মুসলিম পরিষদের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিলমি আহামেদ

দ্বীপ রাষ্ট্র শীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের প্রায় ৭৫ শতাংশই সিংহলিজ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর। অন্যদিকে, দেশটিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৯ শতাংশ। এছাড়া অন্য মাত্র ১৫ শতাংশ হিন্দু রয়েছেন; যারা জাতিগত তামিল সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্য।

বোরকা নিষিদ্ধের যে নথিতে মন্ত্রী উইরাসেকেরা স্বাক্ষর করেছেন সেটি শুক্রবার মন্ত্রিসভার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলে এটি দেশটির সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তবেই আইনে পরিণত হবে।

শনিবার উইরাসেকেরা বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বোরকার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। এটি ধর্মীয় চরমপন্থার একটি লক্ষণ; সম্প্রতি যার উত্থান ঘটেছে। আমরা নিশ্চিতভাবেই এটি নিষিদ্ধ করবো।

২০১৯ সালে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলঙ্কার তিনটি গির্জা এবং বিলাসবহুল তিনটি হোটেলে জঙ্গিদের বোমা হামলায় ২৬৯ জনের প্রাণহানির পর মুসলিম নারীদের বোরকা পরিধান সাময়িক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামি স্টেটের (আইএস) প্রতি আনুগত্য স্বীকারকারী স্থানীয় দু’টি মুসলিম গোষ্ঠী এই হামলার সঙ্গে জড়িত বলে সেই সময় অভিযোগ করে শ্রীলঙ্কা।

হিলমি আহামেদ বলেন, এটিকে (বোরকা পরা) নারীদের অধিকারের একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সরকার করোনাভাইরাসে মৃত ৩৫০ জনের বেশি মুসলিমকে পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য করেছে। 

শ্রীলঙ্কার মুসলিম পরিষদের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিলমি আহামেদ বলেন, এখন সরকার মাদরাসা এবং বোরকা নিষিদ্ধ করতে চায়। একই ধরনের ব্যবস্থা কি খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে নেওয়া হবে?

গত বছরের মার্চে শ্রীলঙ্কার সরকার করোনাভাইরাসে মৃতদের লাশ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশনা জারি করে। দাফন নিষিদ্ধ করে জরিকৃত এই আইনে বলা হয়, লাশ দাফন করা হলে ভূগর্ভস্থ পানিতে ভাইরাসের বিস্তার ঘটতে পারে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং দেশটির মুসলিমদের প্রতিবাদের মুখে গত মাসে শ্রীলঙ্কার সরকার ওই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।

কলম্বোর মানবাধিকার কর্মী ভ্রাই ক্যালি বালথাজার বলেন, করোনাভাইরাসে নিহতদের বাধ্যতামূলক পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্তের পর নতুন করে বোরকা ও মাদরাসা নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে; তা মুসলিমদের জনজীবনের ওপর প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি না যে, যারা বোরকা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা জাতীয় নিরাপত্তা অথবা নারী অধিকারের কথা মাথায় রেখে এটি করেছেন। আমি মনে করি, নারীর ক্ষমতায়নের লড়াইয়ের প্রতীক বোরকা; যা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। লঙ্কান এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, লাশ পুড়িয়ে ফেলার ইস্যুটি মোকাবিলা করার পর এখন আমাদের এটির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এটি মুসলিমদের; বিশেষ করে নারীদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে।

সূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স।

এসএস