আগামী ২৭ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে আট পর্বের বিধানসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে। এবারের এই নির্বাচন ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মঞ্চ। নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধীদল বিজেপির যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে; তার আভাষ মিলেছে কিছু জরিপেকিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যে কি আমূল পরিবর্তন আসবে? নাকি সাম্প্রদায়িক অতীতে ফিরছে পশ্চিমবঙ্গ? এ বিষয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডি ডব্লিউতে সংবাদভাষ্য লিখেছেন সাংবাদিক দেবারতি গুহ।

ভারত থেকে অনেক দূরে জার্মানিতে বসে আমার মন চলে যাচ্ছে অতীতে। মনে পড়ছে সেই রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের কথা।

এমন এক পরিবারে আমার জন্ম, যেখানে সামাজিক মূল্যবোধকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাই আমি এই ভোটের ফল নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। সত্তর ও আশির দশকের কলকাতায় আমি বেড়ে উঠেছি। আমার জেঠু রণজিৎ গুহর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। জেঠু আমাদের সবসময় রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল, বেসরকারিকরণ, বেকারত্ব নিয়ে খোলামেলা, যুক্তিসঙ্গত বিতর্ক করতে বলতেন। আমার বাবার দিকের পারিবারিক ঝোঁক ছিল বামপন্থায়।

অন্যদিকে, মায়ের বাড়ি বা মামা বাড়ি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক। তাদের এই ঝোঁকের অন্যতম কারণ ছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ক্যারিশমা এবং ১৯৭১ সালে বংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে তার যোগ।

আমি কোন পক্ষে থাকব, সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কিছুটা মুশকিলে পড়েছিলাম। তখন বহুত্ববাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত, যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ ছিল। সেই ভারত উন্নয়নের পথে যাবে যদি অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রগতি হয় এবং লক্ষ্যপূরণ সম্ভব হয়। কিন্তু তখন আমার দূরতম কল্পনাতেও আসেনি যে, তিন দশকের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে চলে আসবে ধর্ম।

আমি এখন জার্মানির নাগরিক। তাই পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন নির্বাচনে কে জিতল, কে হারল, তাতে আমার পারতপক্ষে কিছু যায় আসে না। সবদিক থেকে বিচার করলে কিছু জনপ্রিয় প্রকল্প চালু করে তৃণমূল কংগ্রেস গড়পরতা শাসন করেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা বা দুর্নীতি নিয়ে তাদের ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ মোটেই আহামরি নয়। বামেদের প্রভাব কার্যত শেষ হয়ে যাওয়া এবং কংগ্রেসের ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়াটা এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বাস্তব। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থান খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

বিজেপি যে পশ্চিমবঙ্গ জেতার জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছে, তা আর কারো অজানা নেই। এ কথাও সকলে জানেন, ভারতজুড়ে বিজেপি তার প্রভাব বিস্তার করতে চায়। উত্তর ভারতে কিছু রাজ্যে বিজেপি হেরেছে বা ভবিষ্যতে হারতে পারে। তার ক্ষতিপূরণ হতে পারে পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে জয় পেলে। এই মুহূর্তে কেরালা বা তামিলনাড়ুতে বিজেপি জেতার মতো অবস্থায় নেই। সেখানে তাদের আরো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। সেজন্যই নরেন্দ্র মোদির দল পূর্ব ভারতে জয় পেতে মরিয়া। গত বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র তিনটি আসনে জিতেছিল বিজেপি। সেখান থেকে এবার তারা সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখছে।

এখনো পর্যন্ত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয়। জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি বেশিরভাগ সময়েই রাজ্যে বিধানসভা ভোটে খারাপ ফল করে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো জনপ্রিয় নেতা তাদের নেই। এমনকি বলিউডের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তীও জনপ্রিয়তায় মমতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন না বলেই আমার মনে হয়। 

এছাড়া এবার মমতার ইশতেহারও অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। তিনি সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায়, যুব, খাদ্য, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, আবাসন, পরিকাঠামো ও নিরাপত্তার ওপর। এটাকে বলা হচ্ছে, দিদির দশ অঙ্গীকার বা দশ দফা কর্মসূচি। এখন কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো তাদের যাবতীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে টিএমসি ক্যাডারদের ওপর চাপ দিতে চাইবে। আমার আশঙ্কা, ভোটের দিন রিগিং হতে পারে, পক্ষপাতের উদাহরণও আমরা দেখতে পাবো।

অন্যদিকে, বিজেপি ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য টাকা ঢালতে শুরু করেছে। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জন্য তারা সবরকম চেষ্টা করছে। পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি রাজ্য যেখানে ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার আছেন। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরে তাদের সংখ্যা বেশি।

আসলে বাংলার একটা রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাস আছে। দেশভাগের পর ভয়াবহ সংঘর্ষ দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। তাই যখন দেখি, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা হচ্ছে, ঘৃণা তৈরির প্রয়াস হচ্ছে, তখন আমার ভয় হয়। আবার অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না তো!

দুর্ভাগ্যক্রমে মতাদর্শ এখন রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে না। রাজনৈতিক দলগুলো এখন কেবল ক্ষমতা দখল করতে চায়। এ জন্য তারা অস্বাভাবিক জোট করে, এমনকি দীর্ঘদিনের শত্রুতা ভুলে বাম ও কংগ্রেস হাত মিলিয়ে নেয়। এই দুই দল আবার গত মাসে হুগলি জেলার ফুরফুরা শরিফের প্রভাবশালী পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি, যিনি ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট তৈরি করেছেন; তার সঙ্গেও হাত মেলায়।

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বাম ও কংগ্রেস মিলে ১২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সিদ্দিকির সমর্থনে তারা কিছু ভোট ফেরত পাওয়ার আশা করছে, যা তারা সাম্প্রতিক সময়ে হারিয়েছে। এর ফলে মনে হতে পারে, রাজ্যের কিছু আসনে ত্রিমুখী লড়াই হবে। তৃণমূল, বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস জোটের। এখন এটাও দেখার যে, শেষ পর্যন্ত আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এআইএমআইএম কতগুলো আসনে লড়ে। মুসলিম ভোটের ওপর তাদের প্রভাব কতটা পড়ে। তৃণমূলের সাফল্যের পেছনে এই বিষয়গুলো খুবই জরুরি ভূমিকা পালন করবে।

তৃণমূল কংগ্রেসও অবশ্য রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়েছে। তারা ‌‘ইমাম ভাতা’, ‘পুরোহিত ভাতা’ চালু করেছে। এসব ভোট পাওয়ার কৌশল। এই ধরনের কৌশলের পেছনে প্রশান্ত কিশোর আছেন, যাকে নির্বাচনী কৌশল তৈরির জন্য নিয়োগ করেছে তৃণমূল। তিনি আগে অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। এমনকি ২০১২ সালে নরেন্দ্র মোদিকে তৃতীয়বারের জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী করার পেছনেও তার কৌশল কাজ করেছিল। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনেও তিনি বিজেপির হয়ে কাজ করেছেন এবং তার কৌশল দলকে জেতাতে সাহায্য করেছে।

আট পর্বে নির্বাচন হচ্ছে, তাই রাজ্যজুড়ে প্রচার করার জন্য বিজেপি যথেষ্ট সময় পাবে। অন্য রাজ্যে নির্বাচন হয় তিনটি পর্বে। পশ্চিমবঙ্গে আট পর্বে হচ্ছে বলে অসংখ্য জনসভা করতে পারবে বিজেপি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে ভোটপর্ব চলায় তৃণমূল বিপাকে পড়বে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে একইসঙ্গে নির্বাচন হচ্ছে বলে তারা অসুবিধায় পড়তে পারে।

এটা বলাও অত্যুক্তি হবে না যে, অনেক জেলাতে একাধিক পর্বে ভোটগ্রহণ করাটা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে। কারণ তাদের বিভিন্ন জেলার সীমানা ‘সিল’ করতে হবে, যার ফলে অসুবিধায় পড়তে পারে গোটা পশ্চিমবঙ্গ।

এসএস