জ্বালানি সংকট, মূল্যবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে শুধু পরিবহণ ক্ষেত্রে নয়, দৈনন্দিন জীবনে সব ক্ষেত্রেই জ্বালানি সাশ্রয়ের তাগিদ বাড়ছে। জার্মানির উদ্যোক্তা কর্নেলিয়াস পাউল এক অভিনব উপায়ে সে কাজে অবদান রাখছেন।

কর্নেলিয়াসের দাবি, অদূর ভবিষ্যতে জার্মানির বাড়িঘরের ছাদের উপর বিপ্লব আসতে চলেছে; আর সেই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে তার উদ্ভাবিত বিশেষ টালি, যেগুলো সাধারণ টালির মতো সেগুলি ভবনের সুরক্ষাও নিশ্চিত করে, আবার একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সৌর মডিউল হিসেবেও কাজ করে।

সেসব বিশেষ টালিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণও যথেষ্ট। যতক্ষণ সূর্যের আলো থাকে, ততক্ষণে এক পরিবারের চাহিদার তুলনায় বরং বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। সৌর টালির উদ্ভাবক কর্নেলিউস পাউল বলেন, ‘আমরা সহজ হিসেব করতে পারি। ছাদের উপর এক হাজার টাইলের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দশ কিলোওয়াট। একটি পরিবারের দৈনন্দিন কাজের জন্য এই পরিমাণ বিদ্যুৎ যথেষ্ট।’

৪০ হাজার ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতে নিয়ে এই প্রকল্প শুরু করেছিলেন তিনি। ডয়েচে ভেলেকে কর্নেলিউস বলেন, সাধারণ ছাদের উপর আলাদাভাবে সোলার প্যানেল বসানোর ব্যয়ের চেয়ে তার উৎপাদিত টালি ছাদে বসানোর ব্যয় খানিকটা বেশি। তবে সময়ে সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্যয় কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

নিজের কারখানায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে বিশেষ এই টালি উৎপাদন করছেন কর্নেলিউস। ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়াও পাচ্ছেন। তবে পথিকৃৎতের সব সময়ে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। তার উদ্ভাবিত টালি উৎপাদনের জন্য এখনো হাতে করে অনেক কাজ করতে হয়। ফলে জার্মানির পূর্বাঞ্চলে নিজস্ব কারখানায় উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়ে যায়।

আরেকটি বাধা হলো, তার নতুন পণ্যকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য হতে হবে, যাতে কয়েক দশক ধরে বিঘ্ন ছাড়াই টালিকে মজবুত থাকতে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ধরে রাখতে পাারে। কর্নেলিউস বলেন, ‘সৌর মডিউল, তার উপরের সৌর ল্যামিনেট প্রথাগত প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়। উপাদান হিসেবে পরীক্ষিত হওয়ায় এই টালি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো সুযোগ নেই।’

সম্প্রতি এই প্রকল্পে রোবটও কাজে লাগানো হচ্ছে। ফলে কর্নেলিউস আরও বেশি পরিমাণে এবং আরো সস্তায় উৎপাদন করতে পারছেন। দামী সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য নিশ্চিত করতে তিনি বিনিয়োগকারীদের নিজের কোম্পানির অংশীদার করেছেন। এভাবে তার কোম্পানির প্রতি অন্যদের আস্থা আদায় করতে পেরেছেন তিনি। কর্নেলিউস পাউল বলেন, ‘২০১১ সালে আমরা মাত্র তিন জনকে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন প্রায় ৭০ জন কর্মী সক্রিয় রয়েছেন। গত বছর আমাদের টার্নওভার দ্বিগুণ হয়ে ৫০ লাখ ছুঁয়েছে। চলতি বছর আমরা সেটা পাঁচ বা ছয় গুণ করতে চাই।’

জ্বালানি সংকটের কারণে জার্মানির অনেক বাসার মালিকের মনে নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনের তাগিদ বাড়ছে বলে উদ্যোক্তা হিসেবে কর্নেলিউস সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। সেইসঙ্গে সম্প্রতি এমন উদ্যোগের জন্য আরও মোটা অংকের রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে, যে ক্ষেত্রে বেশি জটিলতা ছাড়াই ভবনের রূপান্তর ঘটানো যায়। একটি ভবনের সংস্কারের বর্ণনা দিয়ে কর্নেলিউস বলেন, ‘ছাদে কয়েকটি জায়গায় গর্ত করা হচ্ছে। সেখান দিয়ে প্লাস ও মাইনাস কেবেল ঢোকানো হবে। সেই তার কেবেল চ্যানেলের মাধ্যমে সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানে ইনভার্টার রয়েছে।’

‘টালি বিপ্লবী’ নামে পরিচিতি পাওয়া কর্নেলিউস এখনও ছোট আকারে ব্যবসা করছেন।তবে কোনো এক সময়ে তাঁর সৌর টালি জার্মানিতে বড় আকারে বিক্রি হবে বলে তিনি নিশ্চিত। কর্নেলিউস পাউল মনে করেন, ‘জার্মানিতে দেড় কোটি এমন বাড়ি রয়েছে, যেখানে একটি বা দুটি পরিবার বাস করে এবং আগামী ৩০ বছরের মধ্যে যেগুলোর জ্বালানি কাঠামোর সংস্কার করতে হবে। হয়তো ছাদও খুব পুরানো হয়ে গেছে। সেই হিসেব অনুযায়ী বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ছাদের সংস্কার, অর্থাৎ ২০ থেকে ৩০ কোটি সোলার টাইল সেখানে লাগানো হতে পারে। আমরা সে ক্ষেত্রে অবদান রাখার আশা করছি।’

জার্মানির লোকজন সাধারণত মূল্যের বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। ফলে তাদের মন জয় করা কঠিন হবে। কিন্তু আপাতত যুগের হাওয়া তার জন্য সুবিধা বয়ে আনছে। টালির কার্যকরিতা সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়লে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে আরও ক্রেতা পাওয়া যাবে আশা এই উদ্যোক্তার।

এসএমডব্লিউ