সামনের দিনগুলোর জন্য সেরা উপহার যা হতে পারে তা এরইমধ্যে পৃথিবী পেয়ে গেছে। এত অল্প সময়ে কোভিড-১৯ এর নিরাপদ ও কার্যকরী টিকা পাওয়াটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য কেবল আশ্চর্যজনক এক ঘটনাই নয়, ২০২০ জুড়ে চলা সঙ্কটের সমাপ্তির ইঙ্গিতও বহন করে।  

কিন্তু মহামারি শেষ হতে কতটা সময় লাগবে তা নির্ভর করছে তিনটা বিষয়ের ওপর। প্রথমটা হলো করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকতে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলা ও হাত ধোয়ার মতো যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো খুব ভালোভাবে প্রতিপালন করা। দ্বিতীয়টি হলো বিশ্বের সব প্রান্তে ভ্যাকসিন পৌঁছানোতে লজিস্টিক্যাল ও বিতরণ-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়া। আর তৃতীয়টা হলো দরিদ্র দেশগুলোর ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত করা। পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তে করোনা ভাইরাসকে পরাজিত করতে না পারা পর্যন্ত এ মহামারির শেকড় উপরে ফেলা যাবে না। 

সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের কিছু প্রচেষ্টা ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি। উদাহরণস্বরুপ ১৭২টি দেশের জোট (যুক্তরাষ্ট্র এ জোটে নেই) কোভ্যাক্সের কথা বলা যায়। সব দেশের সব নাগরিকের কাছে দ্রুত, ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাতহীন উপায়ে ভ্যাকসিন পৌঁছানোর নিশ্চয়তা চায় এ জোট। প্রাণঘাতী ও সংক্রামক ব্যাধি থেকে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের জীবনরক্ষায় টিকা প্রদানে ভূমিকা রেখে আসা আন্তর্জাতিক জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহ-নেতৃত্বে কোভ্যাক্স ৯টি ফার্মাসিউটিক্যাল ডেভলপারের কাছ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভ্যাকসিনগুলো অনুমোদন পেলেই তা সংগ্রহ করা হবে। এখন পর্যন্ত এ প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউনিয়নের সদস্য কয়েকটি দেশ। তারা দিয়েছে ৮৫ কোটি ইউরো (১০০ কোটি মার্কিন ডলার)। এরপর পর সবচেয়ে বেশি অর্থ দিয়েছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য বড় দাতারা।  

ভ্যাকসিনের ২০০ কোটি ডোজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২০২১ সালের মধ্যে কোভ্যাক্স ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে চায়। কিন্তু কোনো ভ্যাকসিনের যদি একটি ডোজেও কাজ হয় (এখনও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর দুটি ডোজ প্রয়োজন হয়) তবেও ২০০ কোটি ডোজ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। আর যদিও এমন আশা আছে যে ভারতের মতো দেশগুলোতে উৎপাদকরা স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে, তারপরও বৈশ্বিক যোগান চাহিদার চেয়ে কমই থেকে যাবে।    

কোভ্যাক্সের পাশাপাশি দরিদ্র দেশগুলোতে সরাসরি অর্থায়নেরও একটা চেষ্টা আছে। উদাহরণস্বরুপ বিশ্ব ব্যাংক কিছু দেশে ১৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রতি দিয়েছে। এছাড়া আরও অনেক দাতা ও জনহিতকর সংস্থা একইভাবে অবদান রাখছে। বিশ্ব ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ডের যৌথ উদ্যোগে করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে সাময়িক ঋণ পরিশোধ পরিত্রাণ কর্মসূচির (ডিএসএসআই) আওতায় ৭৩টি দরিদ্র দেশ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ স্থগিত রাখার সুযোগ পেয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুর দিক পর্যন্ত ৪৫টি দেশ এ কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করেছে। 

মহামারির সমাপ্তির জন্য ভ্যাকসিনের সর্বজনপ্রাপ্তি জরুরি। তবে চাহিদার বিষয়টি মাথায় নিলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, দরিদ্র দেশগুলোকে ভ্যাকসিন কেনার জন্য বাড়তি অর্থ বরাদ্দ দিলেই তারা বেশি ডোজ কেনার ক্ষমতা অর্জন করবে কি-না। অনুমোদনপ্রাপ্ত উৎপাদকরা এরইমধ্যে তাদের উৎপাদনক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছেছে। পরিস্থিতির অনেক কিছু অনুকূলে থাকলেও শেষ পর্যন্ত চাহিদা বৃদ্ধির মতো বিষয়ও উৎপাদন বাড়াতে পারবে- এ সম্ভাবনা কমই।   

এর ওপর আগে থেকে নির্ধারিত পরিমাণে বর্তমান অনেক চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে উৎপাদকরা  উৎপাদন খরচেই ভ্যাকসিন বিক্রি করবে। চলতি এই স্টক শেষ হলে একতরফাভাবে ভ্যাকসিন কিনতে যাওয়া দেশগুলোর হাতে বাড়তি অর্থ তুলে দিলে তা শেষপর্যন্ত ভ্যাকসিনের একটা মূল্যযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। যার কারণে বেড়ে যেতে পারে ভ্যাকসিনের দাম আর হারিয়ে যেতে পারে সামগ্রিক কল্যাণের ধারণা। 

নিরাপদ ও কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরির পথে ক্ষতির মুখে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন উদ্যোগ, উন্নয়ন ও উৎপাদনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে উৎসাহ-উদ্দীপনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু ২০২১ সালে ভ্যাকসিনের যে পরিমাণ চাহিদা থাকবে সরবরাহ তা অতিক্রম করতে পারবে- সে সম্ভাবনা কমই। উৎপাদনে ইনসেনটিভ যুক্ত হলেও তা ওই বছরে চাহিদা-যোগানের মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারবে না।  

উদ্বেগের এটাই একমাত্র বিষয় নয়। দরিদ্র দেশগুলোর যদি বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার মতো সক্ষমতা থেকেও থাকে, সেটাতেও তাদের খুব একটা লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে না, কারণ চাহিদার তুলনায় তাদের কাছে যোগান থাকবে কম।  

আর এর মধ্যে যেসব দরিদ্র দেশের কাঁধে ইতোমধ্যে ঋণের বড় বোঝা রয়েছে তারা এই ঋণের কারণে এমন এক পরিস্থিতির মুখে রয়েছে, যা অর্থনীতির অবস্থা স্বাভাবিক থাকলেও তাদের জন্য কঠিন হতো। এসব দেশের মধ্যে যে দেশগুলো ডিএসএসআই সহযোগিতা পাবে তারা হয়তো সেই অর্থ দিয়ে ভ্যাকসিন না কিনে আগের নেয়া ঋণই পরিশোধ করবে। সামষ্টিক অর্থনীতির সংস্কারের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠনে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে সেখানেও ঘাটতি থাকবে। 

এর ফলাফলে যা হতে পারে তা হলো দরিদ্র দেশগুলোতে প্রয়োজনের চেয়ে কম ভ্যাকসিন সরবরাহ। এতে দরিদ্র দেশগুলো লাভবান না হলেও ঋণদাতারা ঠিকই লাভবান হবেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর সরকাররা ভ্যাকসিনের এই তহবিলের অর্থ অন্যান্য খাতে খরচ করে ফেলবে। 

এ পরিস্থিতিতে বেশি ভ্যাকসিন পেতে দরিদ্র দেশগুলোকে সহযোগিতার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে যে, হাতে থাকা ভ্যাকসিনের সুষম বণ্টনের জন্য কোভ্যাক্স ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে পৌঁছানো। যুক্তরাষ্ট্রের নিবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেয়ার পর দেশটি আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর সেটা হলে দরিদ্রে দেশগুলোতে এই ভ্যাকসিন বিতরণ কর্মসূচি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।  

মূল লেখা : প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। লিখেছেন অ্যানে ও. ক্রুয়েগার, সাবেক বিশ্ব ব্যাংক প্রধান।  

এনএফ