রাজপরিবারের একজন একান্ত সচিব একবার বলেছিলেন, ‌‘সারা বিশ্বে প্রিন্স ফিলিপ একমাত্র মানুষ যিনি রানিকে নেহায়েত অন্য একজন মানুষ হিসাবে দেখেন এবং সেভাবেই তার সাথে ব্যবহার করেন। একমাত্র তিনিই এটা করতে পারেন।’ তাদের বিয়ে ছিল প্রেমের। দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। তাদের দেখা হয়েছিল বিয়ের অনেক আগেই।

ডার্টমথ নেভাল কলেজে ১৯৩৯ সালে তোলা ছবি দেখে বোঝা যায় রাজকীয় এই প্রেম-প্রণয়ের সূচনা তখন থেকেই। প্রিন্স ফিলিপ তখন ১৮ বছরের সুদর্শন চনমনে নেভাল ক্যাডেট। বাবা-মার সাথে ওই কলেজ সফরে গিয়ে ১৩ বছরের রাজকুমারী এলিজাবেথের নজর কাড়েন তিনি। কৈশোরের সেই আকর্ষণ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে রূপ নেয়। দু’জন দু’জনকে চিঠি লিখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হঠাৎ মাঝেমধ্যে দেখাও হতো দু’জনের।

প্রিন্স ফিলিপ যখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তরুণী রাজকুমারী তার ঘরে প্রিন্স ফিলিপের একটি ছবি রেখেছিলেন।

যাযাবর রাজকুমার, লাজুক রাজকুমারী

গ্রিস এবং ডেনমার্কের এই রাজকুমারের ছেলেবেলা ছিল অনেকটা যাযাবরের মতো। তার জন্ম গ্রিসের রাজপরিবারে, কিন্তু নির্বাসিত হওয়ায় ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরতে হয়েছে তাকে। এ কারণে অল্প বয়স থেকে তিনি ছিলেন অনেক স্বাবলম্বী এবং শক্ত মনের। রাজকুমার হলেও রাজপ্রসাদের ছায়া তার ওপর ছিল না।

রাজকুমারী এলিজাবেথ ছিলেন তার বিপরীত। তার জন্ম এবং বড় হওয়া ছিল রাজপ্রাসাদের সুরক্ষিত বেষ্টনীর ভেতর। বাইরের জীবনের বাস্তবতার সাথে তার পরিচয় ছিল খুব সামান্য। চুপচাপ লাজুক স্বভাবের ছিলেন তিনি। যে কোন বিষয় নিয়ে অনেক ভাবতেন।

ফলে ভিন্ন প্রকৃতির হলেও তারা দু’জন এক অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। পৌত্র যুবরাজ উইলিয়াম তার দাদা-দাদীর সম্পর্ক নিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘‘দাদা আমার দাদীকে অনেক হাসাতে পারেন। কারণ দাদা এমন কিছু কথা বলেন, এমন কিছু কাজ করেন এবং জীবনের অনেক বিষয়ের ওপর তার যে দৃষ্টিভঙ্গি তার সাথে দাদীর দৃষ্টিভঙ্গির বেশ তফাৎ। ফলে তারা দু’জন দারুণ এক দম্পতি।’’

প্রেমে পুরোপুরি নিমজ্জিত

রাজকুমারীর যখন বিশ বছর, প্রিন্স ফিলিপ তখন বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এক বছর পর ১৯৪৭ সালে এলিজাবেথের ২১তম জন্মদিনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বাগদানের কথা প্রকাশ করা হয়। প্রিন্স ফিলিপ, তার মা গ্রিসের রাজকুমারী এলিসের মাথার টিয়ারা থেকে নেয়া হীরার টুকরো দিয়ে নিজে বাগদানের আংটির নকশা করে দিয়েছিলেন।

বিয়ের আগে তিনি এলিজাবেথের মায়ের কাছে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, এলিজাবেথের প্রতি শতভাগ দ্বিধাহীন প্রেমে নিমজ্জিত তিনি। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে গির্জায় দুই হাজার অতিথির সামনে তাদের বিয়ে হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র দু’বছর আগে। ব্রিটেন তখনও সেই ধাক্কা সামলাতে বিপর্যস্ত। সেই কঠিন সময়ে বিয়ে নিয়ে অনেকদিন পর ব্রিটিশরা উৎসব করেছিলেন। উইনস্টন চার্চিল ওই বিয়ে সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই কঠিন সময়ে এ যেন রঙের এক ঝলকানি।’

বিয়ের পরের বছর জন্ম হয় প্রথম ছেলে চার্লসের। তারপর জন্ম নেয় মেয়ে অ্যান। প্রিন্স ফিলিপ তখন ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে তরতর করে ওপরে উঠছেন। যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস চেকার্সে কাজ করার সূত্রে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনি তখন মাল্টায় থাকেন। রাজপ্রাসাদের বাইরে সেই দাম্পত্য জীবন ছিল অনেক স্বাভাবিক, স্বাচ্ছন্দ্যের এবং উচ্ছলতায় ভরা।

সে সময়কার ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ দেখলে বোঝা যায়— রুটিন রাজকীয় দায়-দায়িত্বের চাপ থেকে দূরে নতুন দম্পতি কীভাবে মাল্টার উষ্ণ আবহাওয়া এবং একে অন্যের সান্নিধ্য উপভোগ করছেন।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজা ষষ্ঠ জর্জের অসময়ে মৃত্যুতে সবকিছু রাতারাতি বদলে যায়। রানি এলিজাবেথের বয়স তখন মাত্র ২৫। প্রিন্স ফিলিপ ৩০ বছরের। তারা জানতেন রাজকুমারী একসময় রানি হবেন, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাকে সিংহাসনে বসতে হবে তা ভাবেননি।

স্ত্রীর সিংহাসনে আরোহণে প্রিন্স ফিলিপকে নৌবাহিনী ছাড়তে হলো। যে মানুষটি যুদ্ধ জাহাজের কমান্ডার ছিলেন, হঠাৎ করে সেই পেশা ত্যাগ করে রানির সঙ্গীর ভূমিকা নেয়া সহজ ছিল না প্রিন্স ফিলিপের জন্য।

সময়টা ভুললে চলবে না। এই পরিবর্তন ঘটছে ১৯৫০ এর দশকে, যখন কোনো পুরুষের জন্য স্ত্রীর উচ্চতর আর্থ-সামাজিক মর্যাদা মেনে নেওয়ার চল ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে, মাত্র ২৫ বছর বয়সী রাজকুমারী; যিনি সবে মা হয়েছেন, ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের দায়িত্ব নেওয়া তার জন্যও সহজ কোনো বিষয় ছিল না।

দ্বৈত ভূমিকা

ভূমিকার এই বদলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে কোনো সমস্যা দেখা দিলেও তা কখনই ঘরের চার দেয়ালের বাইরে বের হয়নি। সম্রাজ্ঞী স্ত্রীর কনসর্ট অর্থাৎ জীবনসঙ্গীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে এবং তাতে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লেগেছিল প্রিন্স ফিলিপের। রাজপ্রাসাদের কর্মচারীদের সাথে এ নিয়ে কম-বেশি বিরোধও হয়েছে তার।

১৯৫৬ সালে, তিনি একা চার মাস বিভিন্ন কমনওয়েলথ দেশে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন যা নিয়ে তখন স্ত্রীর প্রতি তার দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এরপর যখন দু’জন নতুন জীবনে, নতুন ভূমিকায় অভ্যস্ত হয়ে যান; পরের কয়েক দশক সেই তালে আর কোনো ছ্দে পড়েনি। রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা পালনে রানিকে সাহায্য করেছেন ডিউক। পরিবারের প্রধানের দায়িত্ব তুলে নেন নিজের হাতে।

বাইরের বিশ্বের কাছে রানি ছিলেন বস— কর্ত্রী। কিন্তু রাজপরিবারের ভেতরের চিত্র ছিল আলাদা। প্রিন্স ফিলিপ পারিবারিক বার-বি-কিউয়ের দায়িত্বে থাকতেন, আর নোংরা বাসন-চামচ ধুতেন রানি। ১৯৬০ সালে রাজপরিবারের ওপর এক তথ্যচিত্রে দেখা গেছে এসব।

জাতীয় সব বড় বড় অনুষ্ঠানে সবসময় রানির সাথে থাকতেন ডিউক। বিদেশ সফরেও স্ত্রীর সাথে যেতেন। এসব অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ফুটেজে দেখা যায় হঠাৎ দু’জনের মধ্যে চোখাচোখি হচ্ছে এবং হলেই দু’জনের চোখ-মুখে হাসির ঝিলিক।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে, রানি সামনে আসার আগে ডিউক অতিথিদের সাথে বা জড়ো হওয়া মানুষজনের সাথে কথা বলছেন, হাস্যরস করছেন। ফলে স্ত্রীর আগমনের আগেই অনুষ্ঠানে তার এই ‘বরফ গলানো‘ ভূমিকা খুবই কাজে লাগতো।

সম্পর্ক শক্ত থাকার অন্য আরেকটি কারণ তারা দু’জন অনেকসময় নিজের পছন্দমত আলাদা সময় কাটাতেন। ডিউক একবার বলেছিলেন, দু’জনের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ থাকা সুখী দাম্পত্য জীবনের গোপন রহস্য। রানি কুকুর এবং ঘোড়া খুব পছন্দ করেন। ফলে অবসর সময়ে তার ঘোড়দৌড় প্রশিক্ষকের সাথে অনেক আলাপ পরামর্শ করতেন তিনি।

প্রিন্স ফিলিপের পছন্দ ছিল খেলাধুলা। এছাড়া রাজপরিবারের সম্পত্তি জমিদারি দেখভাল করতে পছন্দ করতেন তিনি। জীবনের শেষ দিকে তাকে প্রায়ই দেখা যেত উইন্ডসর পার্কে বা সানড্রিংহাম প্রাসাদের পাশে এস্টেটে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে ঘুরছেন।

২০১২ সালে প্রিন্স হ্যারি বলেছিলেন, যতই মনে হোক যে আমার দাদা নিজের খেয়ালখুশি মতে একা একা অনেক কিছু করছেন— অনেকটা নদীর মাছের মত সাঁতরে বেড়ানোর মতো। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে তাকে ছাড়া আমার দাদী চলতে পারেন বলে আমার মনে হয় না।

২০১৭ সালে প্রিন্স ফিলিপ রাজকীয় দায়-দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। ফলে তখন থেকে বহু অনুষ্ঠানেই রানিকে হয় একা অথবা রাজপরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে নিয়ে হাজির হতে দেখা যায়। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ডিউককে প্রায়ই দেখা যেত সানড্রিংহাম প্রাসাদ সংলগ্ন উড ফার্মে।

শেষের দিনগুলো একসাথে

আনুষ্ঠানিকতা, রাজকীয় কায়দা কানুন তেমন পছন্দ করতেন না প্রিন্স ফিলিপ। রাজকীয় পোশাক পরে কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে দু-চারটে কথা বলার বাইরে তিনি পড়তে এবং লিখতে পছন্দ করতেন। ছবিও আঁকতেন। দায়িত্বের কারণে রানিকে অধিকাংশ সময় লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে থাকতে হতো। সন্দেহ নেই যে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ সময় দু’জনে দুই জায়গায় থাকতেন।

কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর দু’জনকে উইন্ডসর প্রাসাদে একসাথে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। অল্প ক’জন ঘনিষ্ঠ কর্মচারী এবং সহযোগীকে তাদের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যারা এখন এইচএমএস বাবল (বুদবুদ) নাম পরিচিত।

২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিউকের প্রয়াণের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ বিবাহিত জীবনের শেষ দিনগুলোতে মহামারির কারণে তারা সর্বক্ষণ একসাথে কাটিয়েছেন। প্রাসাদের চার দেয়ালের মধ্যে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনের নানা স্মৃতি নিয়ে জাবর কাটার সময় পেয়েছেন।

৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দু’জন দু’জনের সাথী ছিলেন। ফলে প্রিন্স ফিলিপকে সন্দোহাতীতভাবে সাংঘাতিক মিস করবেন রানি।কখনই তারা নিজেদের ভালোবাসা লোকসমক্ষে দেখাননি। কিন্তু ইতিহাসে রানি এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপ অসামান্য এক রাজকীয় প্রেমের উপাখ্যান হয়ে থাকবেন। বিবিসি বাংলা।

এসএস