ভারতজুড়ে করোনার প্রকোপ
মোদিকে মনমোহনের চিঠি, সংকট মোকাবিলার পরামর্শ
ভারতে প্রতি দিন হু হু করে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। এর মধ্যেই টিকা দেওয়ায় শ্লথগতির অভিযোগ উঠছে। টিকার জোগান নেই বলে অভিযোগও করেছে একাধিক রাজ্য। এমন পরিস্থিতিতে মোদিকে পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখেছেন তার পূর্বসূরি মনমোহন সিং।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়ে সুসংহত পদ্ধতিতে রাজ্যগুলোর কাছে টিকা বণ্টনের আহ্বান জানিয়েছেন। করোনা মহামারি সংকট মোকাবিলায় টিকাদান কর্মসূচি জোরালো করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
আগামী ছয় মাসের মধ্যে কোন কোম্পানির কাছ থেকে কত ডোজ টিকা পাওয়া যাবে, কোন কোম্পানিকে কত ডোজ টিকার ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছে, সেসব তথ্য জনসমক্ষে আনার আর্জিও জানিয়েছেন মনমোহন সিং।
দেশকে প্রাধান্য না দিয়ে বিদেশে টিকা পাঠানো নিয়ে এর আগে কেন্দ্রকে আক্রমণ করেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তা নিয়ে মোদিকে তিনিও চিঠি দিয়েছিলেন। যদিও টিকার ঘাটতির অভিযোগ স্বীকার করেনি মোদি নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
এই পরিস্থিতির মধ্যে রোববার ভারতে আরও ২ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাতে সংক্রমণের নিরিখে বিশ্ব তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভারত। মৃত্যুর নিরিখেও ব্রিটেনকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে চতুর্থ স্থানে।
এমন পরিস্থিতিতে রোববার মোদিকে পাঠানো চিঠিতে মনমোহন সিং লিখেছেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে মহামারি সঙ্গে লড়ছে ভারত। অন্য শহরে থাকায় কত বাবা-মা সন্তানের মুখ দেখেনি। কত দাদা-দাদি তাদের নাতি-নাতনিকে দেখেনি। কতদিন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের দেখতে পাননি শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বহু মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন। লাখ লাখ মানুষকে গ্রাস করেছে দারিদ্র্য। তা নিয়ে অনেক কিছু করার থাকলেও, এই মুহূর্তে টিকা দেওয়াকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত আমাদের’।
বিজ্ঞাপন
তবে এখানে থামেননি মনমোহন সিং। দেশবাসীকে সার্বিকভাবে টিকার আওতায় আনতে মোদিকে পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। পরামর্শগুলো হল—
১। সবার আগে আগামী ছয় মাসের পরিকল্পনা জনসমক্ষে আনতে হবে সরকারকে। জানাতে হবে, টিকা উৎপাদনকারী কোন কোন কোম্পানিকে কত ডোজ টিকার অর্ডার দেওয়া হয়েছে এবং কাদের টিকা টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহারের জন্য গৃহীত হয়েছে। আগামী ছয় মাসে কত সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া হবে, তার লক্ষ্যমাত্রা যদি থাকে, তা হলে আগে ভাগে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে, যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেগুলো সরবরাহ করতে পারে ওই সব কোম্পানি।
২। সুষ্ঠু ও সুসংহত পদ্ধতিতে কীভাবে রাজ্যগুলোর মধ্যে ওই টিকা বিতরণ করা হবে, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে। এই জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য মোট সরবরাহের ১০ শতাংশ সরিয়ে রাখতে পারে সরকার। তার বাইরে ঠিক কত টিকার তাদের হাতে দেওয়া হবে, তা রাজ্যগুলোকে জানাতে হবে, যাতে সেই মতো ব্যবস্থা করে রাখতে পারে তারা।
৩। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে ৪৫ বছরের নীচে বয়স হলেও জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের মধ্যে কাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত, তা ঠিক করা যায়। কারণ বয়স ৪৫ না পেরোলেও কোনো রাজ্যের সরকার সবার আগে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাসচালক, অটোচালক, ট্যাক্সিচালক, পৌরসভা ও পঞ্চায়েত কর্মী ও প্রয়োজনে আইনজীবীদের জরুরি পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত করে আগে টিকা দিতে পারে।
৪। গত কয়েক দশকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে ভারত। সরকারি নীতি ও মেধাস্বত্বে সুরক্ষা থাকাতেই তা সম্ভব হয়েছে। এ ব্যাপারে বেসরকারি ক্ষেত্র বেশি ক্ষমতাশালী হলেও, এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে টিকার উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য এবং ছাড় দিতে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। প্রতিষেধক তৈরির জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা দরকার, এইচআইভি-এইডসের সময় যেমনটি হয়েছিল। ইসরায়েল ইতোমধ্যেই লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করেছে। ভারতে যে হারে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে, তাতে এখানেও অতি শীঘ্র তা চালু হওয়া প্রয়োজন।
৫। এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ জোগান যেহেতু সীমিত, তাই ইউরোপীয়ান মেডিকেল এজেন্সি এবং আমেরিকার খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসনের মতো বিশ্বস্ত সংগঠনের ছাড়পত্র পাওয়া টিকা পাওয়া গেলে, তা-ই আমদানি করার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে আলাদা করে দেশে ট্রায়ালের জন্য জোর না দেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করছেন তারা। জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের এই যুক্তি অবান্তর নয়। তবে তা বেশি দিনের জন্য হতে দেওয়া চলবে না। অল্পদিনের মধ্যেই ভারতে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করতে হবে। কোন সংগঠনের ছাড়পত্রের ভিত্তিতে প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে, তা টিকাগ্রহীতাদেরও জানাতে হবে।
টিকা দেওয়ার বর্তমান পদ্ধতি নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন মনমোহন। তার মতে, কত সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া হল, তা নিয়ে মাতামাতি না করে দেশের মোট জনসংখ্যার কত শতাংশকে টিকার আওতায় আনা গেল, তার ওপর জোর দিতে হবে সরকারকে। কারণ এখন পর্যন্ত জনসংখ্যার একটি সামান্য অংশই টিকা পেয়েছেন। সঠিক রূপরেখা মেনে চললে দ্রুতই অসাধ্যসাধন হবে বলে মন্তব্য করেছেন মনমোহন। গঠনমূলক পদ্ধতিতে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই কাজ করে এসেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন মনমোহন।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
এএস