পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচন জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘খেলা হবে’। নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেন সেই স্লোগাটিরই প্রতিধ্বনি উঠল নন্দীগ্রামে। দীর্ঘ টানাপোড়েন ও বিভ্রান্তির পর অবশেষে নন্দীগ্রাম আসনে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশন। পাশপাশি এই আসনে ভোটের পুনর্গণনা হবে না বলেও জানানো হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে।

এর আগে রোববার সন্ধ্যায় নন্দীগ্রাম নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা স্থগিত করেছিল নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি ভারতের নির্বাচন কমিশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার প্রধান কর্মকর্তা আরিজ আফতাব জানিয়েছিলেন, প্রয়োজনে নন্দীগ্রামের ভোট পুনর্গণনা করা হবে।

আরিজ আফতাব এ তথ্য জানানোর এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আগের অবস্থান থেকে সরে এসে শুভেন্দুকে জয়ী ঘোষণা করল কমিশন।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে এবার শুরু থেকেই সবার মনযোগের কেন্দ্রে ছিল নন্দীগ্রাম আসনটি। এই নন্দীগ্রামে আন্দোলনের ফসল হিসেবেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারে আসীন তৎকালীন সিপিএম সরকারকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস।  

একসময়ের কংগ্রেস নেতা শুভেন্দু অধিকারী ২০১১ এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ঘাসফুল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। মমতার সরকারে পরিবহন ও পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লোকসভায় তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব করার অভিজ্ঞতাও আছে শুভেন্দু অধিকারীর।

নন্দীগ্রামের মাটিই সে সময় একসুতোয় বেঁধে দিয়েছিল মমতা বন্দোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীকে। সেবারের বিধানসভা নির্বাচনে মমতার অনতম্য গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী।

কিন্তু এই চিত্র বদলে যায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। যে মাটি তাদের কাছাকাছি টেনেছিল, সময়ের ব্যবধানে সেখানেই একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন তারা দু’জন।

রোববার সকালে ভোট গণনা শুরুর পর অনেকক্ষণ শুভেন্দুই এগিয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে মমতার ব্যবধান ৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

তারপর থেকে শুরু হয় দুই প্রার্থীর ‘সাপ-লুডু’ খেলা। একাদশ রাউন্ডের শেষে দেখা যায় মমতা ৩ হাজার ৩২৭ ভোটে এগিয়ে গেছেন। পরের রাউন্ডেই আবার পিছিয়ে যান সাড়ে ৪ হাজার ভোটে। ষোড়শ রাউন্ড গণনার শেষে মাত্র ৬ ভোটে এগিয়ে যান শুভেন্দু।

গোল বাঁধে সপ্তদশ রাউন্ডে। ওই দফার গণনা শেষ হওয়ার পর ভারতীয় বার্তাসংস্থা এএনআই জানায়, বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীকে ১ হাজার ২০১ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন মমতা।

সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই খবর প্রকাশের এক ঘণ্টার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকা আনন্দবাজার ডিজিটালকে শুভেন্দু অধিকারী জানান, নন্দীগ্রামে মমতা বন্দোপাধ্যায় নয়, তিনি জিতেছেন। শুভেন্দুর দাবি, তৃণমূল কংগ্রেস সভানেত্রীকে ১ হাজার ৬২২ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন তিনি।

এদিকে প্রায় কাছাকাছি সময়ে কলকাতার কালীঘাটে নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন তৃণমূল সভানেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘নন্দীগ্রামের জনগণ যে রায় দেবে, মাথা পেতে নেব।’

সংবাদ সম্মেলনে মমতা বন্দোপাধ্যায় আরো বলেন, ‘আমার কাছে অভিযোগ আছে, নন্দীগ্রামের ভোটে কারচুপি হয়েছে। প্রয়োজনে আদালতে যাব।’

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেন শুভেন্দু অধিকারী। তারপর লাগাতার মমতা ও তার ভাতিজা তৃণমূলের কেন্দ্রীয় নেতা অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যান তিনি। এক পর্যায়ে শুভেন্দু অধিকারীর পথ অনুসরণ করে বিজেপিতে যোগ দেন তার বাবা ও তৃণমূলের সাবেক বিধায়ক শিশির অধিকারীও।

সে তুলনায় অনেক স্তিমিত ছিল তৃণমূল। তবে শুভেন্দু ও তার বাবা শিশির অধিকারীর সঙ্গে সম্পর্কের শেষ পেরেক ঠোকেন মমতা বন্দোপাধ্যায়ই। বিধানসভা নির্বাচনে নিজের আসন ভবানীপুর ছেড়ে দিয়ে নন্দীগ্রামে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন তিনি।

তারপরই বিধানসভা দখলের লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির যাবতীয় সমীকরণ উল্টে যায়। ১০ মার্চ আনুষ্ঠাানিক ভাবে নন্দীগ্রামের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন মমতা। ওই দিনই নন্দীগ্রামে আক্রান্ত হন মমতা। পায়ে আঘাত পান এবং এরপর তা নিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে বিবাদ চরমে ওঠে।

দু’দিন পর ১২ মার্চ নন্দীগ্রাম থেকে বিজেপির হয়ে মনোনয়ন জমা দেন শুভেন্দু। মমতাকে হারানোর চ্যালেঞ্জ জানান তিনি। তার পর থেকে বিজেপি-র হেভিওয়েট নেতারা শুভেন্দুর হয়ে সেখানে সভা করে এসেছেন।

সেই তুলনায় নন্দীগ্রামে তৃণমূলের সভা ছিল মমতাসর্বস্বই। তবে সেখানে জেতা নিয়ে শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন মমতা। রোববার যখন ইভিএমের ভোট গণনা শুরু হলো, তখন প্রথম দিকে পদ্মশিবির এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত নন্দীগ্রামে তৃণমূলের পক্ষে ভোটের পাল্লা ভারী হবে, এমনটাই ছিলো তার ধারণা।

ব্যাটলগ্রাউন্ড নন্দীগ্রামে তুমুল লড়াই হলেও পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ আসনেই এমনটা দেখা যায়নি। একচেটিয়া জিতে মমতার দলই যে হ্যাটট্রিক তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।

এসএমডব্লিউ