ভ্যাকসিন প্রয়োগের শীর্ষে ইসরায়েল
বিশ্বজুড়ে মহামারি ঠেকানোর প্রবল প্রচেষ্টা যখন চলছে, ঠিক তখনই অল্প সময়ের মধ্যে এই ভাইরাসপ্রতিরোধী ভ্যাকসিন প্রয়োগে রেকর্ড গড়েছে ইসরায়েল। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে; ভ্যাকসিন প্রয়োগের এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ।
ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শনাক্তকারী বৈশ্বিক ওয়েবসাইট আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা বলছে, ইসরায়েলে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১১ দশমিক ৫৫ জনকে করোনা ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির পর ভ্যাকসিন প্রয়োগে এগিয়ে রয়েছে ওই অঞ্চলেরই আরেক দেশ বাহরাইন; দেশটিতে ভ্যাকসিন প্রয়োগের হার ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ; ব্রিটেনে যা ১ দশমিক ৪৭।
সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে ইউরোপের দেশ ফ্রান্স; দেশটিতে গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৩৮ জনকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের শিক্ষামূলক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশ্বজুড়ে টিকাদানের এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা। তবে টিকাদানের এই তথ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যারা শুধুমাত্র প্রথম ডোজ নিয়েছেন তাদের। এখন পর্যন্ত বিশ্বের যেসব দেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে; সেসব দেশে এক সপ্তাহের বেশি সময়ের ব্যবধানে দুটি ডোজ প্রয়োগের কথা রয়েছে।
২০২০ সাল শেষের আগে যুক্তরাষ্ট্র ২ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও দেশটি সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দেশটিতে ২৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ করোনা ভ্যাকসিন পেয়েছেন।
ভারতের জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিজিসিআইয়ের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে দেশজুড়ে করোনা টিকাদানের মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে দেশটিতে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
শনিবার ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মুখসারিতে লড়াইরত তিন কোটি মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি শুরু হলে এক কোটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী অগ্রাধিকারভিত্তিতে তা বিনামূল্যে পাবেন। এছাড়া এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইরত আরও ২ কোটি সম্মুখসারির কর্মীকেও ভ্যাকসিন দেয়া হবে।
ইসরায়েলের এগিয়ে থাকার নেপথ্যে
গত ১৯ ডিসেম্বর টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে ইসরায়েল। দেশজুড়ে দৈনিক প্রায় দেড় লাখ ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশটিতে ষাটোর্ধ্ব নাগরিক, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং যারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিকে মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট ফাইজার এবং জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন কেনার ব্যাপারে আলোচনা করে ইসরায়েল। যারা অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাবেন তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে যোগাযোগ করছে দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
দেশটির আইন অনুযায়ী, একজন স্বীকৃত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর কাছে প্রত্যেক ইসরায়েলিকে ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নাম নিবন্ধন করতে হবে।
ইসরায়েলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জুলি এডেলস্টেইন ওয়াইনেট টেলিভিশনকে বলেছেন, মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য দেশজুড়ে ফাইজারের ভ্যাকসিন নিরাপদে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর ফলে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভ্যাকসিনের ছোট ছোট চালান পাঠানো যাবে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন। আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইসরায়েল এই মহামারি থেকে মুক্ত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি। করোনাভাইরাস মহামারির লাগাম টানতে দেশটিতে তৃতীয় দফায় লকডাউন চলমান রয়েছে।
ফ্রান্স কেন পিছিয়ে?
গত ২৭ ডিসেম্বর প্রয়োগ কর্মসূচি শুরুর তিনদিনের মধ্যে মাত্র ১০০ জনের মতো মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়। অন্যদিকে জার্মানি ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়েছে।
করোনাভাইরাসের যেকোনও ভ্যাকসিন অনুমোদনের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ধীরগতিতে এগিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
২৭ সদস্য রাষ্ট্রের এই অঞ্চলের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি গত ২১ ডিসেম্বর ফাইজারের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়; যেখানে যুক্তরাজ্য দেয় ২ ডিসেম্বর এবং যুক্তরাষ্ট্র ১১ ডিসেম্বর।
ফ্রান্সে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম জটিলতার মুখে পড়ে নাগরিকদের মধ্যে এই ভ্যাকসিনের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থাকায়। ১৫টি দেশে জরিপ চালিয়ে ইপসোস গ্লোবাল অ্যাডভাইসর বলছে, ফ্রান্সের মাত্র ৪০ শতাংশ বাসিন্দা ভ্যাকসিন নিতে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে, চীনে ভ্যাকসিন নিয়ে সংশয়ের এই হার ৮০ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৭৭ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯ শতাংশ।
কি করছে ভারত?
চলতি বছরের মাঝের দিকে ৩০ কোটি নাগরিককে ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ইতোমধ্যে টিকাদানের মহড়া সম্পন্ন করেছে ভারত। করোনা মহামারিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সংক্রমণের শীর্ষে থাকা ভারত ব্রিটেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করছে।
এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে দেশটির বিশেষজ্ঞ কমিটি জরুরিভিত্তিতে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের প্রয়োগের সুপারিশ করেছে। ভারতে মহামারি এই ভাইরাসে এখন পর্যন্ত এক কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন; যা বিশ্বের একক কোনও দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দুই কোটি ৬১ লাখের বেশি আক্রান্ত নিয়ে এই মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতে করোনায় এক লাখ ৪৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রে সেই সংখ্যা ৩ লাখ ৫৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোভিশিল্ড নামের এই করোনা ভ্যাকসিন ভারতের পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া উৎপাদন করছে। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের জরুরি প্রয়োগের সুপারিশ ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার (ডিসিজিআই) দফতরে পাঠানা হয়েছে। অনুমোদন পেলে অক্সফোর্ডের কোভিশিল্ড নামের এই ভ্যাকসিন দেশটিতে শিগগিরই প্রয়োগ শুরু হবে। ফাইজারের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের মতো জটিলতা নেই অক্সফোর্ডের এই ভ্যাকসিনের।
এছাড়াও দেশটির ওষুধপ্রস্তুতকারক সংস্থা ভারত বায়োটেকের আরেকটি করোনা ভ্যাকসিন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
করোনার উত্থান এবং বৈশ্বিক মহামারি
• গত বছরের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।
• চীনে করোনায় প্রথম প্রাণহানি ঘটে ৯ জানুয়ারি।
• ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় থাইল্যান্ডে।
• এই ভাইরাসে বিশ্বে প্রথম প্রাণহানি ঘটে ২ জানুয়ারি ফিলিপাইনে।
• ১১ মার্চ ‘করোনা মহামারি’ ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ার পর বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ চলছে। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ কোটি ৪৪ লাখ ৪৯ হাজারের বেশি মানুষ এবং মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার।
সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, এনডিটিভি।
এসএস