করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত পুরো ভারত। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হাজারো মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। আক্রান্তের সংখ্যাও রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে। পুরো ভারতজুড়ে যখন এমন অবস্থা, তখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন বা কালো ছত্রাক সংক্রমণ।

ছত্রাকজনিত এ রোগকে চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় বলা হচ্ছে ‘মিউকোরমাইকোসিস’। করোনায় আক্রান্তদের দেহেই এ রোগ দেখা দিচ্ছে। অনেকে করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েও এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে মারাও যাচ্ছেন। তা ছাড়া দেহের বিভিন্ন ক্ষতি করছে এ ছত্রাক।

মূলত গুজরাট, দিল্লি ও মহারাষ্ট্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন লাফিয়ে বাড়ছে। আহমেদাবাদের বিজে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এ রোগে সংক্রমিত ৬৭ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এক মাসেরও কম সময়ে এ সংক্রমণ ঘটছে। এ রোগের চিকিৎসায় আক্রান্তদের অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে রোগীর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন কমে যায়, ঠিক তখনই কালো ছত্রাক সংক্রমণ ঘটায়। এই রোগে মুহূর্তেই পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে। সংক্রমণ তীব্র হলে রোগী মারাও যেতে পারেন। 

ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হয়ে কমপক্ষে ৮ জন রোগী তাদের এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। এ রোগে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশেরও বেশি। ডিরেক্টোরেট অব মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (ডিএমইআর) প্রধান ডা. তাতিরাও লাহানে বলেন, শুধুমাত্র মহারাষ্ট্রেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ২০০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।     

মিউকোরমাইকোসিস বা কালো ছত্রাক সংক্রমণ কী?  

এটি এক ধরনের গুরুতর ফাঙ্গাল ইনফেকশন (ছত্রাকজনিত সংক্রমণ)। দীর্ঘমেয়াদী (ক্রনিক) কোনো শারীরিক জটিলতা থেকে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে এই রোগের সংক্রমণ দেখা দেয় ভারতের নীতি আয়োগ সংস্থার সদস্য (স্বাস্থ্য) ভি কে পাল বলেন, মিউকর নামক একটি ছত্রাক মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণের জন্য দায়ী। সাধারণত আর্দ্র স্থানে এই ছত্রাক জন্মায়।     

কেন কোভিড আক্রান্তরাই এ রোগে সংক্রমিত হচ্ছেন?

কোভিড মহামারির আগে মিউকোরমাইকোসিস খুব একটা বেশি দেখা যেত না। সাধারণত যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, আগে তারাই এতে আক্রান্ত হতেন। কিন্তু মহামারি শুরুর পর থেকে তিনটি ফ্যাক্টর বেড়ে গেছে। এর মধ্যে একটি কোভিড নিজেই, অন্যটি ডায়াবেটিস এবং তৃতীয়টি স্টেরয়েডের অপব্যবহার যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

ডিরেক্টোরেট অব মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (ডিএমইআর) প্রধান ডা. তাতিরাও লাহানে বলেন, ছত্রাকজনিত রোগটি বাড়ছে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জটিলতা থেকে। এর কারণ স্টেরয়েডের ব্যবহার রক্তে চিনি বা সুগার লেভেল বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কিছু ওষুধ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমিয়ে রাখে।

এমন পরিস্থিতিতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক রোগীকে সহজেই আক্রান্ত করে। যদি এই ছত্রাক মস্তিস্কে পৌঁছে যায় এবং আক্রান্ত করে, তবে তা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে রোগীর একটি চোখ অপারেশন করে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে হয়।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর অন্যান্য জটিলতা থাকলে সহজেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সংক্রমণ পরবর্তী লক্ষণ কী কী ?

মিউকোরমাইকোসিস বা কালো ছত্রাকের সংক্রমণ সাধারণত নাক থেকে উপরের চোয়াল হয়ে মস্তিষ্কে যায়। চোখের নিচে ব্যথা হয়। মুখের একপাশ ফুলে যেতে পারে। মাথাব্যথা, জ্বর, নাকে রক্তজমাট, নাকে (নাসাল ব্রিজ) কালো ঘা দেখা দিতে পারে। কখনও কখনও চোখের দৃষ্টি কমে যায়। একবার যদি এই ছত্রাক মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়, তবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।  

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে কি এ রোগ বেড়েছে?

ডা. লাহানে বলেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় তা নগণ্য। আগে কোভিড থেকে সেরে ওঠার কয়েক সপ্তাহ পর রোগীরা এ ধরনের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসতেন। কিন্তু এবার কোভিডের চিকিৎসা চলাকালেই রোগীদের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে।

চিকিৎসা

এ রোগের চিকিৎসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ওষুধের সরবরাহ নেই বললেই চলে, অন্যদিকে ওষুধের দামও অনেক বেশি। ২১ দিনের জন্য রোগীর বিশেষ এক ধরনের ইনজেকশন প্রয়োজন হয়। এ ইনজেকশনের একেকটির দাম ৯ হাজার রুপি। এছাড়া অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই।

আরএইচ