পূর্ব জেরুজালেমের ছোট্ট এক বসতি শেখ জারাহ। যেখানে বসবাসরত আট ফিলিস্তিনি পরিবারকে উৎখাত করে সেখানে ইহুদি বসতি গড়ার চেষ্টা করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। ইসরায়েলের এই অবৈধ দখলদারিত্ব রুখতে গিয়ে চলতি সপ্তাহে শেখ জারাহতে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ফিলিস্তিনিরা। শেখ জারাহ থেকে পুরো ফিলিস্তিনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলন। অনেকেই ইসরায়েলবিরোধী ফিলিস্তিনি এই প্রতিরোধ আন্দোলনকে নতুন অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছেন।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী শেখ জারাহতে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ ঠেকানোর লক্ষ্যে দুর্গন্ধযুক্ত জলকামান ব্যবহার করে। দিন-রাত একাকার করে ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে তাড়ানোর সব চেষ্টা চালায় ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী। প্রাচীন নগরী জেরুজালেমজুড়ে সহিংস সংঘাত ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

সোমবার ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস গাজা থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে রকেট হামলা শুরু করে। জবাবে গাজায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। সেদিনই গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, হামলায় ৯ ফিলিস্তিনির প্রাণহানি ঘটে।  

পূর্ব জেরুজালেমের ‌‘শেখ জারাহ’ থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে এই শহর। সারি সারি আকাশচুম্বী গাছ, ইট-পাথরের ঘর, বিদেশি কনস্যুলেট এবং বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর ছোট্ট শহর শেখ জারাহ প্রাচীন নগরী দামেস্ক গেইট থেকে মাত্র ৫৫০ গজ দূরে অবস্থিত।

১১৮৭ সালে ক্রুসেডারদের কাছে থেকে জেরুজালেম জয় করার পর মুসলিম শাসক সালাদিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক শেখ জারাহর নামে ওই এলাকার নামকরণ করা হয়। ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম তীর সংলগ্ন এলাকা, পূর্ব জেরুজালেম এবং প্রাচীন নগরী শেখ জারাহ দখলে নেয় ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিরা পুরো জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী মনে করে, যেখানে ইহুদিদের বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত যাজকেরও সমাধি রয়েছে।

শেখ জারাহর অধিকাংশ বাসিন্দাই ফিলিস্তিনি। কিন্তু ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা সম্প্রতি সেখানে দখলদারিত্ব শুরু করেছে। তারা বলছেন, ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগে থেকেই এই এলাকার মালিকানা তাদের।

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর শেখ জারাহর পাশের ওথম্যান ইবনে আফফান স্ট্রিট থেকে যে ফিলিস্তিনিরা উচ্ছেদ হয়েছেন; নাবিল আল-কুর্দ (৭৭) তাদের একজন। তিনি বলেন, ‌‌‘আমার পুরোটা জীবন যে বাড়িতে কাটিয়েছি; সেই বাড়ি থেকে লাথি মেরে বের করে না দেওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল শান্ত হবে না।’ 

২০০৯ সালে আইনি লড়াইয়ের পর ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা নাবিল আল-কুর্দের বাড়ির অর্ধেক দখলে নিয়েছে। এখন তাকে ও তার পরিবারকে বসতিস্থাপনকারীদের থেকে আলাদা করেছে একটি প্রাচীর। আফফান স্ট্রিটে নাবিল আল-কুর্দের টিকে থাকার আশা ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। 

অবৈধ দখলদার ইসরায়েল সেখানকার এই বসতি স্থাপন নিয়ে বিবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে। ইসরায়েলের সরকার বলছে, সম্পত্তি নিয়ে সেখানে কিছু লোকের মাঝে বিবাদ চলছে।

অবৈধ বসতি হটাও

সোমবার শেখ জারাহ থেকে ইসরায়েলবিরোধী যে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছে; তাতে অংশ নিয়েছেন আরব-ইসরায়েলি আইনজীবীরাও। তাদের কারও কারও মুখে ‌‘বসতি স্থাপনকারীদের হটাও’ স্লোগান শোনা যায়। ওথম্যান ইবনে আফফান স্ট্রিটের আইনি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া আইনজীবীরা কট্টর-ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদী বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছিলেন। যদিও পুলিশ পরে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টির পর পশ্চিম তীর, শেখ জারাহ এবং হাইফা থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ হন ফিলিস্তিনিরা। ১৯৫০ এর দশকে জর্ডান শেখ জারাহতে পুনরায় বাড়ি-ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা সেখানে বসবাস শুরু করেন।

ওথম্যান আফফান স্ট্রিটের মালিকানা দাবি করে ইহুদি বসতি স্থাপনাকারীরা মামলা করেছেন। তারা বলেছেন, ১৯ শতকের শেষের দিকে তারা এই জমি দু’টি ইহুদিবাদী সংগঠনের কাছ থেকে কিনেছিলেন।

ইসরায়েলের একটি নিম্ন আদালত বসতি স্থাপনাকারীদের পক্ষে ইসরায়েলি একটি আইন হাজির করেন। এই আইনে ১৯৪৮ সালে জমির মালিকানা হারানোর দাবি করতে পারেন ইহুদিরা। কিন্তু পশ্চিম জেরুজালেম অথবা ইসরায়েলের অন্যান্য অংশে ওই আইনে ফিলিস্তিনিরা একই ধরনের মালিকানা দাবি করতে পারেন না।

শেখ জারাহর বাসিন্দা খালেদ হামাদ (৩০) বলেন, আমাদের পরিবার এখানে শরণার্থী হিসেবে এসেছে। এসব আবার ঘটছে। আফফান স্ট্রিটের ইসরায়েলি এক বাসিন্দা বলেন, উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট ফিলিস্তিনিদের একটি পুরস্কার দিয়েছে। সেটি হলো আফফান স্ট্রিটের মালিকানার মামলার শুনানি পিছিয়ে গেছে। 

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস