অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আপাতত আগামী কয়েক মাস এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে জানিয়েছেন সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা। রোববার (৩ জানুয়ারি) তিনি এ কথা জানান।

এদিকে ভারতের এ নিষেধাজ্ঞার কারণে দরিদ্র দেশগুলোর সাধারণ মানুষের কাছে টিকা পৌছাতে সম্ভবত আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।

মার্কিন বার্তা সংস্থা আসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) দেয়া সাক্ষাৎকারে সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা বলেন, রোববার ভারতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তাদের ভ্যাকসিনের জরুরি অনুমোদন দিয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে- ভারতের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে পারবে না। 

তিনি বলেন, আমরা এ মুহূর্তে শুধু ভারত সরকারকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারবো। এমনকি ভারতের অন্তভ্যরীণ বাজারেও ভ্যাকসিন বিক্রি করা থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভ্যাকসিন মজুদ না করার বিষয়েও নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেন জানান পুনাওয়ালা।

তিনি আরও বলেন, ভারত সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে আগামী মার্চ বা এপ্রিল মাসের আগে ভ্যাকসিন রপ্তানি শুরু করা সম্ভব হবে না।

টিকায় ভাইরাস থেকে মুক্তির আশা জাগলেও এ নিয়ে চিন্তার কারণও রয়েছে। টিকা কিনতে দরিদ্র দেশগুলোর যদি বড় অঙ্কের ঋণ নেয়ার মতো সক্ষমতা থেকেও থাকে, সেটাতেও তাদের খুব একটা লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে না, কারণ চাহিদার তুলনায় তাদের কাছে যোগান থাকবে কম। 

উল্লেখ্য, ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল (ডিসিজিআই) জরুরি অনুমোদনের পর করোনা মহামারিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত দেশটিতে ভ্যাকসিন প্রয়োগের দ্বার উন্মোচিত হয়। ভারতের অনুমোদনের পর বাংলাদেশেও ভ্যাকসিনটির অনুমোদনের বিষয়ে নড়চড় শুরু হয়। জানুয়ারির মধ্যেই ভ্যাকসিনটি হাতে পাওয়া যাবে বলে আশা করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে ভ্যাকসিন হাতে পেতে বাংলাদেশের আরও সময় লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনায় আক্রান্তের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। দেশটিতে এখন পর্যস্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক কোটিরও বেশি মানুষ। আর মারা গেছেন প্রায় দেড় লাখ।

মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং বায়োটেকের তৈরি পৃথক দুটি ভ্যাকসিন প্রয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন ইতোমধ্যে দিয়েছে ভারত।

বাংলাদেশের কী হবে 
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা নেয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। এখন ভারতের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের টিকার ভাগ্য কোন পথে ঘুরলো তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। টিকা পেতে ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক টিকা পেতে ভারতের সেরামকে ৬০০ কোটি টাকা অগ্রিম দেয়ার কথাও ছিল বাংলাদেশের। 

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত করোনার টিকা নিয়ে ৫ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছিল, ভারতের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট অগ্রিম টাকা হিসেবে এটা নেবে এবং বাকি টাকা টিকা সরবরাহ শুরু করার পর দেওয়া হবে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী তারা যদি আগামী জুনের মধ্যে টিকা দিতে না পারে তাহলে বাংলাদেশ অগ্রিম এই টাকা ফেরত নেবে। 

তড়িঘড়ি টিকার অনুমোদনে ভারতে বিতর্ক তুঙ্গে 
দুটি ভ্যাকসিন জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার পর ভারতে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। ভারত বায়োটেকের করোনা ভ্যাকসিন কোভ্যাক্সিনের তৃতীয় ধাপের চলমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ না হওয়ায় অনেক স্বাস্থ্য বিশেষ এই ভ্যাকসিনের অনুমোদনের পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থ দেখলেও দেশটির স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই) সমালোচকদের ‘একেবারে ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেছে।   

সমালোচনা উড়িয়ে ডিসিজিআইয়ের প্রধান ভি. জে সোমানি বলেন, কোনও ভ্যাকসিনের সুরক্ষা নিয়ে সামান্যতম উদ্বেগ থাকলে আমরা কখনই সেটির অনুমোদন দেব না। ভ্যাকসিনগুলো ১১০ শতাংশ নিরাপদ। যেকোনও ভ্যাকসিন নেয়ার পর মৃদু জ্বর, ব্যথা এবং অ্যালার্জির মতো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একেবারে সাধারণ ঘটনা। ভ্যাকসিনের সুরক্ষা ব্যাপারে যে গুজব ছড়িয়েছে তা ভিত্তিহীন। 

এই ভ্যাকসিন নেয়ার পর মানুষের শরীরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ঘাড়ে হালকা ব্যথা, মৃদু জ্বর ও সামান্য অ্যালার্জি হতে পারে বলে জানান। 

সব দেশ টিকা পাবে? 
১৭২টি দেশের একটি জোট (যুক্তরাষ্ট্র এ জোটে নেই) কোভ্যাক্স। সব দেশের সব নাগরিকের কাছে দ্রুত, ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাতহীন উপায়ে ভ্যাকসিন পৌঁছানোর নিশ্চয়তা চায় এ জোট। প্রাণঘাতী ও সংক্রামক ব্যাধি থেকে দরিদ্র দেশগুলোর শিশুদের জীবনরক্ষায় টিকা প্রদানে ভূমিকা রেখে আসা আন্তর্জাতিক জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহ-নেতৃত্বে কোভ্যাক্স ৯টি ফার্মাসিউটিক্যাল ডেভলপারের কাছ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভ্যাকসিনগুলো অনুমোদন পেলেই তা সংগ্রহ করা হবে।  

ভ্যাকসিনের ২০০ কোটি ডোজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ২০২১ সালের মধ্যে কোভ্যাক্স ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে চায়। কিন্তু কোনো ভ্যাকসিনের যদি একটি ডোজেও কাজ হয় (এখনও অনুমোদিত ভ্যাকসিনগুলোর দুটি ডোজ প্রয়োজন হয়) তবেও ২০০ কোটি ডোজ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। আর যদিও এমন আশা আছে যে ভারতের মতো দেশগুলোতে উৎপাদকরা স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে, তারপরও বৈশ্বিক যোগান চাহিদার চেয়ে কমই থেকে যাবে। এরপরও আপাতত ভারত টিকা রপ্তানি করতে পারবে না বলে যে সিদ্ধান্ত জানা গেল তাতে পরিস্থিতি কার্যত আরও জটিল হচ্ছে।

টিএম/এনএফ