দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা  ‘কিস্সাতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে ১৪তম পর্ব। 



সভ্যতার বিকাশে মানুষ ছাড়া যে প্রাণীটির অবদান সবচেয়ে বেশি সেটি হচ্ছে ঘোড়া। মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ঘোড়া এবং মানুষের মধ্যে সেই আদিকাল থেকেই সহজাত বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তারপর থেকে ঘোড়া হয়ে ওঠে মানুষের বিশ্বস্ত সহচর। আজকের উত্তরাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা যখন ছিল না, তখন দূরযাত্রার জন্য ঘোড়াই ছিল একমাত্র বাহন। পণ্যদ্রব্য পরিবহন ও কৃষিক্ষেত্রেও সেকালে ঘোড়া ব্যবহৃত হতো। তবে ঘোড়া সবচেয়ে আলোচিত যুদ্ধক্ষেত্রে এর ভূমিকার জন্য। কত সাহসী যোদ্ধার কত তেজস্বী ঘোড়া যে কত রাজ্যজয়ের সঙ্গী হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এজন্যই ইতিহাসে ঘোড়া বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

অল্প বয়স থেকেই আমি ঘোড়া পছন্দ করতাম। প্রথম প্রেম এবং প্রথম ঘোড়ার মধ্যে পার্থক্য যদি আমাকে বলতে বলা হয় আমি বলবো- প্রথম ঘোড়া এবং প্রথম প্রেম আমার জন্য একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

আমি এমন একটি বাড়িতে বড় হই  যেখানে আমার বাবা তার ঘোড়া দুবাইয়ের চারদিকে লাগাম ছাড়াই চালাতেন। আমার বড় ভাইয়েরও একটি ঘোড়া ছিল। তার ঘোড়াটি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে পিঠে উঠতে দিত না। কেউ জোর করে উঠলে তাকে প্রচণ্ড আঘাতে ফেলে দিত।  

আমার ভাই হামদানেরও ঘোড়া ছিল। ক্ষিপ্রতার কারণে ভাই ঘোড়াটির নাম রেখেছিলেন “কারওয়ান”।

আমি এমন একটি পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, যেখানে প্রায় প্রতিদিনই শীতের রাতে সবাই মিলে যখন আগুনের চারপাশে একত্রিত হতাম, তখন আমাদের  গল্প শোনানো হতো। সেখানে শোনা একটি গল্প ছিল এরকম- আল্লাহ তায়ালা যখন ঘোড়া তৈরি করতে চেয়েছিলেন তখন দক্ষিণ থেকে এক মুষ্ঠি বাতাস নিয়ে বলেছিলেন, আমি তোমার স্রষ্টা। আমি তোমাকে দিয়ে এমন একটি মাখলুক সৃষ্টি করতে চাই যে হবে পিতৃপুরুষদের কাছে সম্মানের উৎস ও সম্ভ্রান্ত, আমার অনুগত লোকদের জন্য হবে রক্ষাকারী। তুমি ডানা ছাড়াই উড়বে।

হ্যাঁ, আমরা এই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েছি। আমি যখন ঘোড়া দেখি তখন আমি তার মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারি। আমাদের বাড়িতে নারীরা বলতেন যে, জিন বা মন্দ আত্মারা যে তাঁবুতে খাঁটি আরব ঘোড়া রয়েছে সেখানে প্রবেশ করার সাহস করে না।

১৩তম পর্ব : ছোট্ট একটা ঘর থেকে পাওয়া ‘সম্পদ’ 

অনেকে বলে যে আজ আমি বিশ্বের অন্যতম সেরা ঘোড়ার মালিক। তবে অনেকেই জানেন না যে আমার শৈশবকালে যখন আমার মা আমার বিছানায় রাতে আমাকে খুজেঁ পেতেন না, তিনি আমাকে ঘোড়ার আস্তাবলে খুজঁতেন। তিনি জানতেন যে, আমি আমার ঘোড়ার সঙ্গে শুয়ে আছি। আমি আমার ঘোড়াকে ভালোবাসি। ঘোড়ার সঙ্গে দীর্ঘ সখ্যতার পর আজ আমি বিশ্বের অন্যতম সেরা ঘোড়ার মালিক।  

ঘোড়ার সাথে আমার সম্পর্কের শুরু সুন্দর এক সন্ধ্যায়। আমি বাবার সাথে মরুভূমি থেকে ফিরছিলাম। আমরা মাগরিবের নামাজের জন্য থামলাম। নামাজ শেষে আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, আমি দুবাইয়ে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে চাই। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং আমি চাই তুমি এতে অংশ নেবে। আমার বয়স তখন প্রায় দশ বছর। তবে আমার বাবা যা বলেছিলেন তাতে আমার মনে হয়েছিল, আমার বয়স বিশ বা ত্রিশ। আমার বাবার কথা আমাকে অনেক শক্তি দিয়েছিল। আমার বাবার অনেকগুলো ঘোড়া ছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন যেকোনো একটি বাছাই করে নিই এবং সেটিকে প্রশিক্ষণ দিই।

তবে বাছাই করতে গিয়ে আমি হয়ে গেলাম তৃতীয়। কারণ, প্রথমে আমি আমার বড় দুই ভাইকে সুযোগ দিই। বড় ভাই মাকতুম ও হামদান তাদের ঘোড়া নির্বাচন করার পর আমার পালা আসে। আমি সব সময়ই আমার বড় ভাইকে সামনে রাখতাম। এখনও আমি তাদের সম্মান করি না, যারা তাদের বড় ভাইকে সম্মান করে না।

আমি আমার বাবার কাছে একটি সুন্দর ঘোড়া দাবি করলাম। তবে যেটি পেলাম সেটি আহত ছিল। আর কেউই তাকে প্রশিক্ষণ দেয়নি। আমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলাম এবং বুঝতে পেরেছিলাম যে সে দৌড়ে অংশ নিতে পারবে। তার নাম ছিল ‘সুদা’ (উম্মে হাল্লাজ)।

আরবরা যখন নিজেদের ঘোড়াকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করতে চাইতো তখন তারা তার কানে সোনার দুল পরাতো। ঘোড়ার গলায় সোনার ও রৌপ্যের মালা পরাতো। ঠিক যেন একজন সুন্দরী নারী। সুদার কানের দুলটি একবার কোনো  কিছুতে আটকে গিয়েছিল। তাই তার ডান কানের ডগাটি উপর থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল এবং এই চিহ্নটি তাকে চেনার জন্য বিশেষ আলামত হয়ে উঠেছিল।  

আমার মা ভেষজ চিকিৎসায় দক্ষ ছিলেন। আমি মাকে বলি, ঘোড়াটিকে দেখতে, তাকে চিকিৎসা করতে। ঘোড়াটি বুঝতে পারত যে, আমার মা তার চিকিৎসা করছেন। আমি তখন থেকেই ঘোড়ার বুদ্ধিমত্তা দেখে অবাক হই।

আমার মা আমাকে ঘোড়াটির খুড়গুলো ছেটে রাখতে বলেন। আঘাতের জায়গায় ভেষজ- মিশ্রণ দিয়ে দিতে বলেন। ব্যথা উপশম করতে ভেষজ পানীয়ও খাওয়াতে বলেন। তারপরে ধীরে ধীরে চলার জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করতে বলেন। আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করি, কতদিন সময় লাগবে? তিনি বলেন, তিন মাস সময় লাগবে।

এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রতিযোগিতার বাকি ছিল  চার মাস। অথচ তিন মাস সময় লাগবে ঘোড়াটির সুস্থ হয়ে উঠতে। আমার এখনও ঘোড়ার চিকিৎসার কথা ও তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা মনে পড়ে। কারণ, এটা ছিল আমার কর্মতালিকার শীর্ষে।

আমার মায়ের চিকিৎসায় ভেষজ ও  অন্যান্য উপকরণ ছিল। তিনি এ থেকে একটি মিশ্রণ তৈরি করতেন এবং কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন আমার ঘোড়ার ক্ষতস্থানে তা লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতেন, আবার পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলতেন।

আমি আস্তাবলে অনেক সময় কাটিয়েছি। টানা ১০ দিন হলুদ গুঁড়ো দেওয়ার পরে ফোলাভাব কমে যায়। 

আমি প্রতিদিন ঘোড়াটিকে একটু একটু করে হাঁটাতাম। আমি ধীরে ধীরে এটা শুরু করেছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছিল।  

আমি এই ঘোড়াটি থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি শিখেছি কীভাবে এই সুন্দর প্রাণীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। আমি শিখেছি, বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের সম্পর্ক। ঘোড়ার সাথে কীভাবে কথা বলবো এবং যোগাযোগ করবো তা শিখেছি। আমি শিখেছি যে আপনি যদি ঘোড়ার উপকার করেন তাহলে তা আরও কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে। আমি ঘোড়া থেকে সবক নিয়েছি কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বস্ততার।

আমার ঘোড়াটি আমাকে শিখিয়েছিল যে সোনার প্লেটে কোনো অর্জন আসে না। আমি তিন মাস অবিরাম আমার ঘোড়ার সঙ্গে কাটাই। তার জখম পরিষ্কার করি। তার পট্টি পরিবর্তন করি। তাকে দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা হাঁটাই। সমুদ্র সৈকতে তার সঙ্গে সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটাই। 

এনএফ