আরব সাগরে অবস্থিত ভারতের ‌‘লাক্ষাদ্বীপ’ স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর সাদা বালুর জন্য ‌‘ভারতের মালদ্বীপ’ হিসেবে পরিচিত। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে বেশ কিছু ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে দ্বীপপুঞ্জটি গঠিত। দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন সংসদ সদস্যের নতুন আইনের প্রস্তাব নিয়ে এই দ্বীপে উদ্বেগ থেকে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। নিকটতম ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের রাজ্য কেরালার হাইকোর্টের আওতাধীন লাক্ষাদ্বীপ।

বিরোধীরা বলছেন, নতুন যেসব আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে তা জনবিরোধী এবং দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার জন্য হুমকিস্বরূপ।

লাক্ষাদ্বীপের শিক্ষার্থীদের টুইটারে হ্যাশট্যাগে ‘লাক্ষাদ্বীপ বাঁচাও (#SaveLakshadweep)’ কর্মসূচির মাধ্যমে শুরু হওয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ গত সপ্তাহে ব্যাপক আলোচনায় আসে। দেশটির বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধীসহ প্রখ্যাত রাজনীতিকরাও লাক্ষাদ্বীপের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন।

ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, মাদকের অপব্যবহারের অভিযোগে ২৩ জনকে গ্রেফতার ও স্থানীয় এক কর্মকর্তার এ বিষয়ে মন্তব্যের জেরে খারাপ লাগা থেকে মুসলিমপ্রধান লাক্ষাদ্বীপে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়।

সোমবার কেরালার বিধানসভায় লাক্ষাদ্বীপের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা ও প্রশাসক প্রফুল প্যাটেলের অপসারণের দাবিতে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

বিক্ষোভ কেন? 

কেরালা থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপ ৩৬টি কোরাল দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এই দ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার এবং যাদের বেশিরভাগই মুসলিমই।

আরব সাগরে অবস্থিত ‘লাক্ষাদ্বীপ’ স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর সাদা বালুর জন্য ভারতীয় মালদ্বীপ হিসেবে পরিচিত। যে কারণে পর্যটকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় এই দ্বীপ। ভারতের প্রেসিডেন্টের নিয়োগকৃত একজন প্রশাসক এই দ্বীপ পরিচালনা করেন। 

প্রফুল প্যাটেল গত বছরের ডিসেম্বরে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি বেশ কিছু নতুন বিধি-নিষেধ আরোপের প্রস্তাব করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো এই দ্বীপে কারা বসবাস করতে পারবেন অথবা নগরায়ন অথবা উন্নয়নের জন্য দ্বীপের কোন বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে; সেবিষয়ে একমাত্র প্রশাসকই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। 

প্রস্তাবিত একটি আইনে বলা হয়েছে, প্রশাসক যে কাউকে আটক এবং কোনও ধরনের বিচারকার্য ছাড়াই সেই ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত আটকে রাখতে পারবেন।

অন্যান্য প্রস্তাবনায় লাক্ষাদ্বীপে গরু জবাই নিষিদ্ধ এবং কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মদ্যপানীয় বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত এসব আইনকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ লাক্ষাদ্বীপের বাসিন্দাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি পর্যটননির্ভর এই দ্বীপে মদ বিক্রি এবং মদ্যপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

প্রফুল প্যাটেলের ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে প্রায়ই ভারতজুড়ে একই সংস্কৃতি চালুর চেষ্টার সমালোচনা রয়েছে। আর এ নিয়েই দ্বীপের বাসিন্দাদের ভয় যে, তারাও সাংস্কৃতিক সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছেন।

এসব বিষয়ে জানতে প্রফুল প্যাটেল এবং স্থানীয় জেলা কালেক্টরের অফিসে বারবার যোগাযোগ করেও কোনও মন্তব্য পায়নি রয়টার্স।

ক্ষোভের শুরু যেভাবে

লাক্ষাদ্বীপ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (এলএসএ) চলতি মাসের শুরুর দিকে টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামে লাক্ষাদ্বীপ বাঁচাও হ্যাশট্যাগে ক্যাম্পেইন শুরু করে। তাদের এই আন্দোলন গতি পায় কেরালার বিধানসভার সদস্য এলামারাম করিমের নজরে আসার পর। এই দ্বীপের সুরক্ষায় তিনি ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি লেখেন।

ভারতের বিরোধীদল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে চিঠি লেখেন। চিঠিতে প্রস্তাবিত আইন প্রত্যাহার নিশ্চিতের আহ্বান জানান তিনি। টুইটারে রাহুল বলেন, ‘লাক্ষাদ্বীপ হলো মহাসাগরে ভারতের রত্ন। ক্ষমতার লোভে অন্ধরা এই দ্বীপকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। আমি লাক্ষাদ্বীপের জনগণের পাশে আছি।’

দ্বীপের বাসিন্দারা দৈনন্দিন ব্যবহারিক জিনিসপত্রের জন্য কেরালার ওপর নির্ভরশীল। সোমবার কেরালার বিধানসভায় লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক প্রফুল প্যাটেলের নিয়োগ পুনর্বিবেচনার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ের আনা একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে।

এই দ্বীপপুঞ্জের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য কেরালা। কারণ সেখানকার বাসিন্দারা মৌলিক জিনিসপত্রের সরবরাহের জন্য পুরোপুরি কেরালার ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া লাক্ষাদ্বীপের অনেকেই কেরালায় শিক্ষা, চাকরি অথবা চিকিৎসার জন্য যান।

প্রস্তাবিত আইন কোন পর্যায়ে আছে?

চলতি বছরের শুরুর দিকে লাক্ষাদ্বীপে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। করোনা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে প্রফুল প্যাটেলের মহামারি নিয়ন্ত্রণ বিধি-বিধান শিথিল করার অভিযোগ রয়েছে। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘করোনা বিধি শিথিলের ফলে লাক্ষাদ্বীপের পর্যটন আরও বিকশিত হবে এবং বিধি-বিধান শিথিলের সিদ্ধান্ত বাতিলের কোনও পরিকল্পনা তার নেই।’

লাক্ষাদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোবিন্দ এখন পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করেননি। এদিকে, লাক্ষাদ্বীপ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং অন্যান্য নাগরিক সংগঠন তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

লাক্ষাদ্বীপ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আজিম ফায়িজ বলেন, প্রশাসকের পদ থেকে প্রফুল প্যাটেলের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা প্রতিবাদ চালিয়ে যাবো।

সূত্র: রয়টার্স।

এসএস