তালেবানকে ঠেকাতে হেরাতে আফগান সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে কয়েকশ উপজাতীয় যোদ্ধা

আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের পর দেশের আরও দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানী লস্করগাহ ও হেরাত এখন তালেবানের হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তুমুল লড়াই চলছে তিনটি শহরেই এবং যে কোনো সময় এ শহরগুলোর পতন হতে পারে বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন।

এছাড়া আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারে গত রোববার তালেবানের রকেট হামলার পর বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কান্দাহারের দখল নিতে পারলে তালেবানের কাছে তা হবে বিশাল এক প্রতীকী বিজয়। কারণ একসময় তালেবানের কেন্দ্রই ছিল এই শহরটি।

হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানী লস্করগাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তালেবান অবস্থানের ওপর সরকারি বাহিনী গত কয়েকদিন ধরে বিমান হামলা চালালেও পরিস্থিতি নাজুক। এ শহরটি দখল নিতে পারলে ২০১৬ সালের পর এই প্রথম তালেবান কোনো প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ পাবে।

পশ্চিমের সবচেয়ে বড় শহর হেরাতের নিয়ন্ত্রণ রাখতে আফগান সেনাবাহিনীর কম্যান্ডোরা শক্ত প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করছে। গত শুক্রবার তালেবান সেখানে জাতিসংঘ অফিসের চত্বরে হামলা চালায়, কিন্তু জানা গেছে সরকারি বাহিনীর পাল্টা হামলার পর পিছু হটে তালেবান।

হেরাতের সাবেক গভর্নর এবং সাবেক এক মুজাহেদিন কম্যান্ডার ইসমাইল খান কয়েকশ' উপজাতীয় যোদ্ধাকে নিয়ে হেরাতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করছেন। কিন্তু কতদিন সরকারি বাহিনী তালেবানকে প্রতিরোধ করতে পারবে তা নিয়ে কাবুল সরকার থেকে শুরু করে মার্কিন সরকার- সবাই উদ্বিগ্ন।

আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গত সোমবার পার্লামেন্টে এক ভাষণে পুরো পরিস্থিতির জন্য তড়িঘড়ি করে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারকে দায়ী করেন। গনি বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে আগে থেকেই বার বার সতর্ক করেছিলেন।

টার্গেট - প্রাদেশিক রাজধানী
গ্রাম এবং ছোট শহরগুলোর পর এখন তালেবান তাদের কৌশলের অংশ হিসাবে বড় বড় শহরগুলো, বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানীগুলো টার্গেট করছে। অনেকে এখন ধরেই নিচ্ছেন যে আফগান সেনাবাহিনীর যে শক্তি, রসদ এবং মনোবল- তাতে অনেক শহরের পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রও এতোটাই উদ্বিগ্ন যে, তালেবান পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এমন সম্ভাবনা নাকচ করেননি মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক রাইলি। গত ২১ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল রাইলি বলেন, আফগানিস্তানের ৩৪টিরও মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রদেশের রাজধানীর প্রান্তে চাপ তৈরি করেছে তালেবান।

তার এই স্বীকারোক্তির পর গত ১৫ দিনে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। কান্দাহার, হেলমান্দ এবং হেরাতের মত বড় বড় কিছু প্রদেশ ছাড়াও তাখার, গজনী এবং চীনের সীমান্তবর্তী বাদাখশান প্রদেশগুলোর পুরোটাই তালেবানের দখলে চলে যেতে পারে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন।

হিমশিম অবস্থা আফগান সেনাবাহিনীর
গত ২০ বছর ধরে শত শত কোটি ডলার, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্র-সরঞ্জাম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের কয়েকটি দেশ এবং সেই সাথে ভারত মিলে সাড়ে তিন লাখ সদস্যের যে আফগান সেনাবাহিনী গড়ে তুললো- তারা কতটা লড়াই করতে পারছে? এর উত্তরে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা আফগান সরকারের জন্য স্বস্তির কোনো বিষয় নয়।

অনেক জেলায় গত কয়েক সপ্তাহে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য লড়াই না করে ইউনিফর্ম খুলে পালিয়ে গেছে। অনেক নিরাপত্তা চৌকি খালি করে সৈন্যরা চলে গেছে। গত জুলাই মাসে ১৬০০ আফগান সৈন্য সীমান্ত পেরিয়ে তাজিকিস্তানে পালিয়ে যায়। এটি কাবুলের সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর একটি ঘটনা ছিল।

দুর্নীতি আর দুর্বল মনোবল
একটি গেরিলা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এমন হিমশিম খাবার মত অবস্থা কেন হলো আফগান সেনাবাহিনীর? গবেষণা সংস্থা আফগানিস্তান অ্যানালিস্ট নেটওয়ার্কের গবেষক রজার হেমস্‌ কদিন আগে তার একটি বিশ্লেষণ রিপোর্টে লিখেছেন, আফগান সেনাবাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে তার অনেক ধারণাই ভুল ছিল।

তিনি বলছেন, এটি এখন পরিষ্কার আফগান সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ছিল খুবই দুর্বল, আর তালেবানের প্রস্তুতি ছিল খুবই শক্ত। দুর্নীতি ও তার ফলে সৃষ্ট দুর্বল মনোবলকে কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন তিনি।

রজার্স আরও বলছেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের লোকজন তাদের পদকে টাকা বানানোর একটি মোক্ষম উপায় হিসাবে বিবেচনা করেন। যে কোন দেশ বা প্রতিষ্ঠান যখন আয়ের জন্য পরের দিকে তাকিয়ে থাকে- তখন এই পরিণতি হতে হতে বাধ্য।

তার মতে, ২০০১ সাল থেকে এভাবেই চলছে আফগানিস্তান। বিদ্রোহী তৎপরতায় অক্সিজেন যোগাচ্ছে দুর্নীতি।

এছাড়া আফগান সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অব্যাহত অসন্তোষ ওপেন সিক্রেট। সৈনিকরা অনেক সময় অভিযোগ করেন, সময়মত তাদের বেতন দেওয়া হয় না। খাবার যথেষ্ট নয়। রসদের অভাব। এমনকি লড়াইতে নিহত বা আহত সহযোদ্ধাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য যানবাহনও মেলে না।

এরপরও অদূর ভবিষ্যতে তালেবান পুরো আফগানিস্তান কব্জা করে ফেলবে বলে মনে করেন না লন্ডনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এবং নিরাপত্তার বিশ্লেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা। তিনি বলেন, আফগান সেনাবাহিনীর যে শক্তি এবং আয়তন তাতে পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

‘সে কারণেই তারা বড় বড় শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণের ধরে রাখার কৌশল নিয়েছে। তাদের লড়াই অবশ্যই অব্যর্থ হচ্ছে না, আমেরিকানদের ছাড়া তারা এই প্রথম লড়াই করছে। কিন্তু আমি মনে করি শহর দখলে রাখতে তালেবানকে বেগ পেতে হতে পারে।’

তার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে ড. সিদ্দিকা বলেন, তালেবানের একচ্ছত্র বিজয় আঞ্চলিক শক্তিগুলোও চাইছে না। তিনি বলেন, রাশিয়াও তা চাইছে না, চীনও চাইছে না।

‘তারা প্রস্তুতি নিয়েছে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে। কিন্তু তারা চায় না তালেবান একক শক্তিধর হয়ে আবির্ভূত হোক। সবাই কম-বেশি চাইছে একটা জাতীয় ঐক্যমত্য আফগানিস্তানে তৈরি হোক- যাতে স্থিতিশীলতা থাকে।’

তিনি বলেন, সেজন্যই চীন যেমন সরাসরি তালেবানের সাথে কথা বলছে, তেমনি কাবুল সরকারের সাথেও যোগাযোগ রাখছে। অনেক বলতে শুরু করেছেন সেপ্টেম্বরেই কাবুলের পতন হবে। অমি তা মনে করি না। এখনই বলে দেওয়ার সময় আসেনি যে তালেবান ১৯৯৬ সালের মত পূর্ণ বিজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম