মানবপ্রাচীর করে ভারতে পাস হলো বিমা বেসরকারিকরণ বিল
সংসদের নিরাপত্তাকর্মী বা মার্শালরা রাজ্যসভা চেয়ারম্যানের আসন, সেক্রেটারি জেনারেলের চেয়ার ও রাজ্যসভার কর্মীদের টেবিল ঘিরে রেখেছেন। একেবারে দুর্গের প্রাচীরের মতো। পুরুষ ও নারী মার্শালদের সেই মানবপ্রাচীর ভেদ করে কোনো বিরোধী সংসদ সদস্য এগোতে পারছিলেন না। মার্শালদের সঙ্গে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি চলছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্যদের। বিরোধীরা বিল, অন্যান্য কাগজপত্র ছিঁড়ে ওড়াচ্ছেন। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদি সরকার গণতন্ত্রকে খুন করছে। সরকারি বিমা সংস্থাগুলোকে বন্ধু শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এমন উত্তাপের মধ্যেই রাজ্যসভায় মার্শাল নামিয়ে মোদি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের বিল পাস করল। বুধবার (১১ আগস্ট) সন্ধ্যায় সংসদে বিল পাসের কিছুক্ষণ আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যবসায়ীদের সভা সিআইআইয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রেও বেসরকারি সংস্থাকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমানো হচ্ছে। এসব কঠিন সিদ্ধান্ত সম্ভব হচ্ছে, কারণ দেশ শিল্পমহলের ওপর ভরসা করে।’ সাধারণ বিমা ব্যবসা (জাতীয়করণ) আইনের সংশোধনী বিলে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থায় সরকারের হাতে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তত ৫১ শতাংশ মালিকানা রাখার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারি বিমা সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পথে আর কোনো বাধা থাকছে না।
বিজ্ঞাপন
কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে মঙ্গলবার কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, বাম সংসদ সদস্যরা রাজ্যসভার কর্মীদের টেবিলে উঠে পড়েছিলেন। বিরোধীরা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের আসন তাক করে ফাইলও ছোড়েন। বিরোধীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিলেন, বুধবার বিমা বিল পাসের চেষ্টা হলে এর থেকেও বেশি গণ্ডগোল হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্যের পরই স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার বিমা বেসরকারিকরণ বিল পাস করাতে বদ্ধপরিকর। রাজ্যসভায় বিরোধীরা হট্টগোল শুরু করতেই কিছুক্ষণের জন্য সভা মুলতবি করে মার্শাল নামানো হয়। তারা বিরোধীদের আসনের সামনে দুর্গ তৈরি করে ফেলেন।
বিজ্ঞাপন
বিল পাসের পর তৃণমূলের দোলা সেন, কংগ্রেসের ছায়া বর্মা অভিযোগ তুলেছেন, মার্শালরা তাদের ধাক্কা দিয়েছেন। বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেন, ‘নারী সংসদ সদস্যদের অপমান করা হয়েছে।’ এনসিপি সভাপতি শরদ পওয়ার বলেন, ‘আমার ৫৫ বছরের সংসদীয় জীবনে এভাবে নারী সংসদ সদস্যদের উপর হামলা হতে দেখিনি। চল্লিশ জনের বেশি পুরুষ-মহিলা মার্শাল রাজ্যসভায় নামানো হয়েছিল। এ ঘটনা যন্ত্রণাদায়ক। এটা গণতন্ত্রের ওপর হামলা।’ ঘটনার প্রতিবাদে বিরোধীরা ওয়াক-আউট করেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন, বিরোধী সংসদ সদস্যরাই মার্শালদের কলার ধরে টানাহেঁচড়া করেছেন। সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশীর অভিযোগ, ‘সংসদে মার্শালদের উপরে কোনো দিনও হামলা হয়নি। এটা সংসদের অপমান। দোষীদের কড়া শাস্তি হওয়া দরকার।’
রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিমা ক্ষেত্রেও আন্দোলন চলছে। বিল প্রত্যাহারের পাশাপাশি বিরোধীদের দাবি ছিল, এ বিল আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। ডিএমকে সংসদ সদস্য তিরুচি শিবা সেই প্রস্তাব আনলেও তা খারিজ হয়ে যায়। ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজু জনতা দল সাধারণত মোদি সরকারের পাশে থাকে। তারাও বিমা বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন। সরকার তাদের কথাতেও কান দেয়নি।
এরপরও যে ভারত সরকার বেসরকারিকরণের নীতিতে অনড় থাকবে, তা বুঝিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, সরকার এসব সংস্কার ‘বাধ্যবাধকতা’ থেকে নয়, নিজস্ব ‘বিশ্বাস’ থেকে করছে। মোদির বক্তব্য, অতিমারির সময়েও সংস্কারের কাজ চলছে। কয়লা খনন, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, পরমাণু ক্ষেত্রও বেসরকারি সংস্থার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিলগ্নিকরণ দফতরের সচিব তুহিন পাণ্ডে সিআইআই সভায় জানিয়েছেন, সরকার সরকারি সম্পত্তি বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে ছয় লাখ কোটি টাকা ঘরে তোলার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাওয়ার গ্রিড করপোরেশনের পরিকাঠামো, জাতীয় সড়ক। চলতি বছরই এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম, শিপিং করপোরেশন, পবনহংস, বিইএমএল-এর মতো সংস্থার বিলগ্নিকরণ হবে। অর্থবছরের শেষ দিকে জীবন বিমা নিগম বা এলআইসি-র শেয়ারও বাজারে ছাড়া হবে।
সূত্র: আনন্দবাজার
এসএসএইচ