আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার অভিযান যে এত তড়িৎগতির হবে তা কখনও কল্পনাও করতে পারেনি দেশটির ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্পের অংশীদার ভারত। কয়েকদিন আগে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বলেছিল, অতীতের নীতি পাল্টে তালেবানের সঙ্গেও আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। 

সেই শান্তি প্রক্রিয়ার হাল যে এই হবে, তা হয়তো আন্দাজে ছিল না নয়াদিল্লির। রোববার কাবুল দখলের মুখে দাঁড়িয়ে তালেবান প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে ভারতকে জানিয়ে দিয়েছে, আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠালে বিপদ ঘটতে পারে।

আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেওয়ার পর কাবুলেও ঢুকে পড়েছে তালেবান। এমন পরিস্থিতিতে রোববার তালেবানের মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেছেন, ‘যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আফগান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য আসেন, তাহলে সেটা তাদের জন্য ভালো হবে না। আফগানিস্তানে অন্য দেশের সেনাদের সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা সবাই দেখেছে। তারা এলে আগে থেকে সব জেনেশুনেই আসবেন।’

তবে সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের মানুষের জন্য ভারতের অবদানের প্রশংসাও করেছেন শাহিন। তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানের মানুষের জন্য সেতু নির্মাণ, অবকাঠামোর উন্নয়নে অনেক সাহায্য করেছে ভারত। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা এই ভূমিকার প্রশংসা করছি।’

আফগানিস্তানের উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে নিজ নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে ভারত, আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ। তালেবানের নেতা শাহিন অবশ্য বলেছেন, ‘দূতাবাস ও কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিদের কোনও ক্ষতি আমরা করব না। তাদের নিশানা করা হবে না। আমরা সেটা জানিয়েও দিয়েছি। ভারত তাদের নাগরিকদের জন্য যে চিন্তা করছে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা তাদের কিছু করব না।’

এই পরিস্থিতিতে আফগানবিষয়ক কাতার-জোট (ভারত, জার্মানি, তাজিকিস্তান-সহ কিছু দেশ যার সদস্য) বলেছে, শক্তি প্রয়োগ করে আফগানিস্তানে সরকার গঠন করা হলে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এসব দেশের স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়ার ওপর ঘটনার গতি আদৌ নির্ভর করবে না।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সন্দেহ নেই যে, বিশ বছর পর তালেবানের এই উত্থানের পেছনে সম্পূর্ণ সহযোগিতা রয়েছে দু’টি বড় দেশ চীন এবং রাশিয়ার। এত দ্রুত যে পরিস্থিতির অবনতি হবে, তা ভারতের যাবতীয় হিসেব-নিকেশের বাইরে ছিল বলেই আঞ্চলিক কূটনীতিতে হতচকিত অবস্থায় পড়েছে নয়াদিল্লি।

অথচ শুধুমাত্র ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নন, কাবুল এবং পাকিস্তান নীতিকে নতুন করে সাজাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিশ্বস্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে। তার তালেবান-দৌত্যও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। অন্যদিকে, আফগানিস্তান সরকারও ভঙ্গুর। বরং নিঃশব্দে পাকিস্তান, ইরান এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে তালেবান নেতৃত্বের যোগাযোগ এখনও রয়েছে।

আমেরিকা তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই খুশি। তার বেশি কোনও আন্তর্জাতিক দায় মেটানোর ইচ্ছা বাইডেন সরকারের আপাতত নেই। উপমহাদেশ নিজেদের মধ্যে যুযুধান হলে, তাতে বিশেষ কিছু এসে যাবে না বাইডেন প্রশাসনের, যতক্ষণ না তার আঁচ আমেরিকায় গিয়ে পড়ছে।

শুধু আমেরিকা নয়; সম্প্রতি ভারতের পুরনো মিত্র রাশিয়ার সঙ্গেও তালেবান-প্রশ্নে মতবিরোধ দেখা গেছে নরেন্দ্র মোদির সরকারের। ইরান এবং ব্রিটেনের সঙ্গেও মতপার্থক্য ঘটেছে নয়াদিল্লির। তালেবান রাশিয়াকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারে, সন্ত্রাস আফগানিস্তানের বাইরে গড়াবে না। ফলে তালেবানি শাসন নিয়ে নাক গলাতে চায় না মস্কো। অনুরূপ আশ্বাস পেয়েছে ভারতের আদি অকৃত্রিম শক্তি-সহচর ইরানও।

সম্প্রতি ব্রিটেনের পক্ষ থেকেও ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তালেবান যদি ক্ষমতায় আসে, তবে তাদের স্বীকৃতি দিতে কোনও সমস্যা নেই। আফগানিস্তান-পাকিস্তান নীতির ক্ষেত্রেও ব্রিটেনের সমর্থন রয়েছে পুরোপুরি ইসলামাবাদের দিকে, এমন আশঙ্কা ছড়াচ্ছে দিল্লিতেও। তবে ব্রিটেন বরাবরই নিজেদের ভূকৌশলগত অবস্থানের জন্য আফ-পাক অঞ্চলের নিরাপত্তা বহাল রাখতে সবচেয়ে কার্যকরী বলে মনে করেছে।

ফলে আফগানিস্তান এবার তালেবানি রাষ্ট্র হয়ে উঠলেও তাতে পাকিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলোর ভূমিকা এবং প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আপাতত একাই লড়তে হবে নয়াদিল্লিকে।

এসএস