বিশ্বের অন্যতম ধনী এই গোষ্ঠীর অর্থ আসে কোথায় থেকে?
তালেবানকে বিশ্বের অন্যতম ধনী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিসেবে মনে করা হয় এবং দুই দশক ধরে মার্কিন ও তার মিত্র বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার পর তারা এখন আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করছে। সশস্ত্র ইসলামি এই গোষ্ঠীর আয় কীভাবে হয় কিংবা কোথায় থেকে আসে, তা হয়তো অনেকেই জানেন না। চলুন জেনে নেওয়া যাক...
কতটা সম্পদশালী তালেবান?
বিজ্ঞাপন
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছে তালেবান। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার হামলার পর আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোটের অভিযানে ক্ষমতাচ্যুত হয় ইসলামি এই গোষ্ঠী। ২০ বছরের যুদ্ধে হাজার হাজার তালেবান যোদ্ধার মৃত্যুর পরও আফগানিস্তানের এই গোষ্ঠীর আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ এবং সামরিক সক্ষমতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের আনুমানিক ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ যোদ্ধা ছিল; যা এক দশক আগে ছিল প্রায় ৩০ হাজার। নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশের বাইরের এবং অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ তহবিলের প্রয়োজন হয় তাদের।
বিজ্ঞাপন
২০১১ সাল থেকে এই গোষ্ঠীর বার্ষিক আয় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ। কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের শেষের দিকে তালেবানের এই আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে বছরে দেড় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
অর্থ কোথায় পায় তালেবান?
আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে বিবিসির অনুসন্ধানে এই গোষ্ঠীটির একটি অত্যাধুনিক আর্থিক নেটওয়ার্ক এবং কর ব্যবস্থা চালানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অর্থ উপার্জনের বেশ কিছু উৎসও তৈরি করেছে তারা। তালেবানের আয়ের প্রধান কিছু উৎস দেখে নেওয়া যাক...
১. বিদেশি অনুদান
বেশ কিছু আফগান এবং মার্কিন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান, ইরান এবং রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে তালেবানদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ করে আসছেন।
তালেবানের আয়ে পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারসহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ থেকে আসা বেসরকারি নাগরিকদের ব্যক্তিগত অনুদান সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হয়।
সঠিকভাবে পরিমাপ করা অসম্ভব হলেও তহবিলের এসব উৎস তালেবানের রাজস্বে উল্লেখযোগ্য অনুপাত সরবরাহ করছে বলে ধারণা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অনুদানের পরিমাণ বছরে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি হতে পারে।
দাতাদের এই সংশ্লিষ্টতা দীর্ঘদিনের। যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে তালেবান বিদেশি উৎস থেকে ১০৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে; যার সিংহভাগ এসেছে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে।
২. মাদক বাণিজ্য
অবৈধ মাদক ব্যবসাসহ বিদ্রোহী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তালেবান দীর্ঘদিন ধরে একটি কর ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্তান। এই আফিম পরিশোধনের মাধ্যমে হেরোইন তৈরি করা হয়।
আফগানিস্তানের অন্যতম প্রধান ব্যবসা আফিম। প্রত্যেক বছর আনুমানিক দেড় থেকে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আফিম রফতানি করে দেশটি। বিশ্বজুড়ে বেশির ভাগ হেরোইনের সরবরাহকারীও আফগানিস্তান।
আফগান সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, আফিম চাষীদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ কৃষি কর আদায় করা হয়। এছাড়াও আফিমকে হেরোইনে রূপান্তরিত করা ল্যাবরেটরির পাশাপাশি অবৈধ মাদক পাচারকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও কর আদায় করা হয়।
ধারণা করা হয়, অবৈধ মাদক থেকে তালেবানের বার্ষিক অর্থ আয়ের পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। আফগান পুনর্গঠন বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মহাপরিদর্শক ও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জন নিকোলসন ২০১৮ সালে বলেছিলেন, তালেবানের বার্ষিক আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশই মাদক ব্যবসা থেকে আসে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তালেবানের আয়ের বিষয়ে এই ধারণা এক ধরনের অতিরঞ্জন।
তালেবান প্রায়ই মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে। ২০০০ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন কিছু দিনের জন্য আফিম চাষ নিষিদ্ধ করা নিয়ে গর্বও করে তারা।
৩. নিয়ন্ত্রণ পরিধি বাড়াচ্ছে তালেবান
তালেবানের আর্থিক নেটওয়ার্ক আফিমের ব্যবসায় কর আরোপের বাইরেও বিস্তৃত। ২০১৮ সালে লেখা এক খোলা চিঠিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় ভ্রমণের সময় জ্বালানি, নির্মাণ সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর কর প্রদান করতে হবে বলে আফগান ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দেয় তালেবান।
আফগান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তালেবান এখন দেশের প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক রুটের পাশাপাশি সীমান্ত পারাপার নিয়ন্ত্রণ করছে। এর ফলে আমদানি ও রফতানি থেকে তাদের আয়ের আরও সম্ভাব্য উৎস তৈরি হয়েছে। গত দুই দশকে পশ্চিমা অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশও তালেবানের পকেটে চলে গেছে।
প্রথমত, তালেবানরা রাস্তাঘাট, স্কুল এবং ক্লিনিকসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও অবকাঠামো প্রকল্পের ওপর কর আরোপ করেছে। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে পশ্চিমাদের অর্থায়নে।
দ্বিতীয়ত, তালেবান দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েনরত আন্তর্জাতিক বাহিনীর সরবরাহকারী ট্রাক চালকদের কাছ থেকে কর আদায় করে বছরে কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় করেছে বলে ধারণা করা হয়।
এছাড়া আফগান সরকারকে দেওয়া বিভিন্ন ধরনের সেবা থেকেও তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে বলে মনে করা হয়। ২০১৮ সালে আফগানিস্তানের বৈদ্যুতিক কোম্পানির প্রধান বিবিসিকে বলেছিলেন, তালেবানরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল আদায়ের মাধ্যমেই বছরে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করে।
এবং সংঘাত থেকেও তারা সরাসরি অর্থ উপার্জন করেছে। প্রত্যেকবার তালেবানের যোদ্ধারা যখন একটি সামরিক চৌকি অথবা শহরের কেন্দ্র দখলে নিয়েছে, তখনই তারা কোষাগারের সব অর্থ লুট, প্রচুর অস্ত্র, গাড়ি এবং সাঁজোয়া যান জব্দ করে।
৪. খনি এবং খনিজ সম্পদ
খনিজ এবং মূল্যবান পাথরে সমৃদ্ধ আফগানিস্তান। বছরের পর বছর ধরে সংঘর্ষের কারণে এসব সম্পদের বেশিরভাগই অনুত্তোলিত থেকে গেছে। আফগান সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, দেশটির খনি শিল্পের আনুমানিক মূল্য বার্ষিক প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দেশটির এই খনিজ সম্পদের উত্তোলনের পরিমাণ খুবই সামান্য এবং এর বেশিরভাগই করা হয় অবৈধভাবে।
দেশটির খনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যে তালেবান নিজেদের দখলে নিয়েছে। বৈধ এবং অবৈধভাবে খনিজ সম্পদ আহরণের সাথে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে অর্থও আদায় করছে তারা।
জাতিসংঘের বিশ্লেষণমূলক সহায়তা ও নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ দল ২০১৪ সালে বার্ষিক এক প্রতিবেদনে জানায়, তালেবানরা দেশটির দক্ষিণ হেলমান্দ প্রদেশের ২৫ থেকে ৩০টি অবৈধ খনির সম্পদ আহরণ কার্যক্রম থেকে বছরে ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
এসএস