তাইওয়ানের পাশে চীনের এত যুদ্ধবিমান কেন?
তাইওয়ানের আকাশসীমা আর সমুদ্রসীমার কাছে চীনের সামরিক তৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত রোববার তাদের বিমান প্রতিরক্ষা সীমানা লঙ্ঘন করেছে চীনের ১৯টি যুদ্ধবিমানের একটি বহর। এর মধ্যে পারমাণবিক বোমা হামলায় সক্ষম এমন অন্তত চারটি এইচ-৬ যুদ্ধবিমান ছিল।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী তাইওয়ান বলেছে, চীনা বিমান হটাতে তারা সাথে সাথে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা প্রস্তুত করেছিল এবং একইসঙ্গে পাল্টা যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছিল। তবে চীনের কাছ থেকে এখনও এ নিয়ে কিছু শোনা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
গত প্রায় এক বছর ধরে তাইওয়ান ক্রমাগত অভিযোগ করছে যে, তাদের আকাশসীমার খুব কাছ দিয়ে বারবার চীনা যুদ্ধবিমান উড়ে যাচ্ছে। তাদের সমুদ্রসীমায় চীনা জাহাজ ঢুকে পড়ছে বলেও অভিযোগ করেছে তাইওয়ান।
তাইওয়ানের দেওয়া হিসাবে, জুনে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা এলাকার ভেতর ২৮টি চীনা যুদ্ধবিমান উড়ে যায়– যা ছিল এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চীনা বিমান বহর। এর আগে, গত ২৪ জানুয়ারিতে ঢুকেছিল ১৫টি চীনা বিমান। আর ১২টি এপ্রিল ঢুকেছিল ২৫টি বিমান।
বিজ্ঞাপন
গত সপ্তাহে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, চীনের হুমকি বাড়ছে এবং চীনের সামরিক বাহিনী তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকেজো করে দিতে পারে বলে আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
শুধু তাইপে সরকারই নয় তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের সম্ভাব্য পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক সেনা কমান্ডার সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। তাদের কথা, চীন হয়তো শেষ পর্যন্ত তাইওয়ান দখলের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল জন আ্যাকিলিনো মাস তিনেক আগে মার্কিন সিনেটের সেনাবাহিনী সম্পর্কিত কমিটিতে বলেছেন, তাইওয়ান দখল এখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ‘এক নম্বর অগ্রাধিকার।’
তার আগে অ্যাডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসন– যিনি এপ্রিলের আগ পর্যন্ত তিন বছর ধরে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কম্যান্ডার ছিলেন – বলেন, তিনি মনে করেন যে আগামী ছয় বছরের মধ্যে চীন তাইওয়ান দখলে সেনা অভিযান চালাবে।
এসব মন্তব্য নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহলে অনেক আলোচনা-বিতর্কের পর জুনে মার্কিন সেনাপ্রধান জেনারেল মাইক মাইলি কংগ্রেসের একটি কমিটির শুনানিতে বলেন, চীন ছয় বছরের মধ্যে তাইওয়ান দখল এবং সেই দখল ধরে রাখার শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে। কিন্তু, তিনি যোগ করেন, খুব সহসা চীন তা করতে চাইবে বলে তিনি মনে করেন না।
প্রশ্ন উঠছে, চীন এতদিন পর সত্যিই তাইওয়ানের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি-না। বিবিসিকে কুয়ালালামপুরের ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার চীনা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেন, ‘আমি বলবো চীন প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেক দিন ধরেই নিচ্ছে। তার মতে, তাইওয়ান নিয়ে চীনের নীতি বহুদিন ধরেই খুব স্পষ্ট।
তিনি বলেন, ‘মাও সে তুং থেকে শুরু করে শি জিন পিং সব চীনা নেতাই চীন তাইওয়ানকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখেছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব এই দুই অংশের পুনঃএকত্রীকরণ চেয়েছেন।’
ড. আলী বলছেন, ‘চীনের নীতি খুব স্পষ্ট – তাইওয়ান তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাইওয়ানের কোন সরকার যদি কখনও স্বাধীনতা ঘোষণা করে বা সেখানে বিদেশি কোন শক্তির সামরিক উপস্থিতি চীন দেখে, তাহলে তারা সামরিক অভিযান চালাবে। এ নিয়ে চীনে একটি আইন করা হয়েছে। এটি এখন চীনা সংবিধানের অংশ।’
তাহলে তাইওয়ান স্বাধীনতা ঘোষণা করবে বা বিদেশি শক্তির সাহায্য নেবে – এমন কোন আশঙ্কা কি হালে চীনের মধ্যে তৈরি হয়েছে?
ড. মাহমুদ আলী বলছেন, তেমন কোনও স্পষ্ট আলামত না দেখা গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ানের বর্তমান সরকারের কিছু আচরণ এবং সেইসাথে তাইওয়ান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গতিবিধি নিয়ে চীন ক্ষুব্ধ।
২০১৬ সালে সাই ইং ওয়েন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি তাইওয়ানের জন্য একটি পৃথক সার্বভৌম পরিচিতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। চীনের সাথে তাইওয়ানের ঐতিহাসিক যোগাযোগের বিষয়টি তিনি মুছে দিতে চাইছেন।
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা ব্যয়ও বাড়িয়েছেন তিনি। বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্র বিশেষ করে বিমান প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনছেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।
চীন তাইপের বর্তমান সরকারের এসব কাজ পছন্দ করছে না। পাশাপাশি ২০১৬ সালে নির্বাচনে জিতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাইকে ফোন করেন, যা নিয়ে চীন তাদের ক্ষোভ চেপে রাখেনি।
ড. মাহমুদ আলী বলছেন, ‘তাইপের বর্তমান সরকারের আচরণে বেইজিং ক্ষুব্ধ। সেই সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের টেলিফোনকে চীন তাইওয়ানকে নতুন করে স্বীকৃতি দেওয়ার কূটনৈতিক একটি ইঙ্গিত হিসাবে দেখেছে।’ তিনি মনে করেন, ঘন ঘন তাইওয়ানের বিমান প্রতিরক্ষা এলাকা লঙ্ঘন করে চীন তাদের অসন্তোষের জানান দিচ্ছে।
তবে তাইওয়ান সরকার এবং অনেক মার্কিন কম্যান্ডার চীনের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করতে শুরু করলেও সে দেশেরই অনেক বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষক এখনও তা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করছেন।
তারা মনে করেন, মার্কিন সেনা কমান্ডারদের কাছ থেকে চীনা হুমকি নিয়ে এসব কথাবার্তার মূলে রয়েছে চীন-মার্কিন সম্পর্কে ক্রমাবনতির প্রতিফলন এবং সেই সাথে দিনে দিনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সামরিক শক্তির ভারসাম্যে ব্যবধান কমে আসা নিয়ে তাদের উদ্বেগ।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) গবেষক বনি গ্লেসার সম্প্রতি আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, তাইওয়ান নিয়ে মার্কিন জেনারেলদের ধারণার পেছনে শক্ত গোয়েন্দা তথ্য নেই। বরঞ্চ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সামরিক শক্তির ভারসাম্য নিয়ে তাদের মধ্যে যে উদ্বেগ, তার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা এসব কথা বলছেন।’
এ বছরের গোড়ার দিকে তাইওয়ান নিয়ে তার এক ভাষণে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বলেন, তাইওয়ানের পুনঃএকত্রীকরণ নিশ্চিত করতে সামরিক ব্যবস্থা তিনি নাকচ করছেন না। যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই তার এই বক্তব্যের ভেতর সামরিক আগ্রাসনের গন্ধ পেয়েছেন।
কিন্তু গ্লেসার বলেন, ‘এই হুমকি নতুন নয়। সব চীনা নেতাই বলেছেন, তাইওয়ানকে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত হতেই হবে। সুতরাং শি নতুন কিছু বলেননি। আসলে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত রেষারেষি বাড়ায় পিপলস লিবারেশন আর্মি এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে এই হুমকির ধারণা স্থান পাচ্ছে।’
চীনের সাথে ১৯৭৮ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চুক্তির শর্তে যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন’ নীতি মেনে নেয় এবং তাইওয়ান থেকে তাদের সামরিক ঘাঁটি প্রত্যাহার করে নেয়। চীনের সাথে আলাপ আলোচনা চলার সময়েই অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের মধ্যে তাইওয়ান থেকে সব মার্কিন সৈন্য চলে যায়।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে চীনের প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র এবং পূর্ব এশিয়ার তাদের প্রধান মিত্র জাপান উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তাদের ভয়, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সামরিক প্রভাব প্রসারে চীন তাইওয়ানে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারে।
ড. মাহমুদ আলী বলছেন, ‘তাইওয়ান চীনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে সেখানে চীন নৌ এবং বিমান ঘাঁটি করতে পারবে। তার অর্থ, তাইওয়ান প্রণালী ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অংশে চীনের প্রতিপত্তি প্রসারের বড় সুযোগ তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্র কোনওভাবেই তা চায় না। জাপানও এ নিয়ে শঙ্কিত।’
আর এই শঙ্কা থেকেই চলতি বছর জাপান প্রথমবারের মত তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলে তাইওয়ানকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘এক-চীন’ নীতি অনুসরণ করলেও তাইওয়ানকে অস্ত্র-সরঞ্জাম সরবরাহ করে যাচ্ছে। এ নিয়ে ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইনও হয়েছে।
তবে জাপান আক্রান্ত হলে তাদের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসা নিয়ে টোকিওর সঙ্গে যেমন প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, তাইওয়ানের সাথে তেমন চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র এখনও রাজি হচ্ছে না।
চীনের সাথে রেষারেষিতে সুবিধা করতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি তাইওয়ানের সাথে তেমন কোন বোঝাপড়ার কথা ভাবেন, তখন চীন-তাইওয়ান পরিস্থিতি সত্যিকারের বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এএস