সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, অং সান সু চিসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনেক শীর্ষ নেতাকে। এর বিপরীতে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এছাড়া অনিশ্চয়তায় পড়েছে দেশটিতে চলমান বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যুত্থানের ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির অর্থনীতি। এছাড়া মিয়ানমারে কর্মরত বিভিন্ন কোম্পানি বলছে, দেশটিতে তাদের বিনিয়োগ করা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।

এদিকে সোমবার এক বিবৃতিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার ঘটনায় মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, (সামরিক) শক্তি কখনও মানুষের ইচ্ছা বা মতামতকে অবদমিত করতে পারে না। এমনকি একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ফলাফলকেও পাল্টে দেওয়া যায় না।

দীর্ঘ সামরিক শাসনের কবল থেকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসায় গত দশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই দেশটিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার অন্যতম।

ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও মিয়ানমারের ওপর তার প্রভাব পড়বে খুব সামান্যই। কারণ সু চির এই দেশটিতে মূলত বিনিয়োগ আসে এশীয় দেশগুলো থেকেই।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মিয়ানমারে বিদেশী বিনিয়োগের তালিকায় সবচেয়ে ওপরে ছিল সিঙ্গাপুরের নাম। মিয়ানমারে মোট বিনিযোগের ৩৪ শতাংশই করেছিল এশিয়ার এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি। এরপরই ২৬ শতাংশ বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল হংকং।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরে মিয়ানমারে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) হয়েছে প্রায় ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের। এর মধ্যে রিয়েল এস্টেট ও নির্মাণখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ করে।

লাভবান হবে চীন?
সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভ্রিয়েনস এন্ড পার্টনারস নামে গভার্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে মিয়ানমারে বিভিন্ন প্রকল্পে চলমান বিনিয়োগের মধ্যে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব বিনিয়োগ মূলত জ্বালানী, অবকাঠামো ও টেলিকমিউনিকেশন খাতে করা হয়েছে।

ভ্রিয়েনস এন্ড পার্টনারস’র ব্যবস্থাপনা অংশীদার হ্যান্স ভ্রিয়েনস বলছেন, ‘তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এসব বিনিয়োগ এখন বড় ঝুঁকিতে।’

তার মতে, ‘করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে বেশ বাজেভাবেই বিপর্যস্ত মিয়ানমার। একইসঙ্গে বিনিয়োগ খরাতেও ভুগছে এই দেশটি। আর এখন আমরা এই সংকটে (সামরিক অভ্যুত্থান) পড়লাম।’

নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তা মিয়ানমারের অর্থনীতির ওপরে বেশ ভালোভাবেই প্রভাব ফেলবে। এছাড়া পশ্চিমা ও জাপানি কোম্পানিগুলো মিয়ানমারে তাদের প্রকল্প নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের হুমকি দিয়েছেন।

আর তাই ব্যবসা ও বিনিয়োগ মিয়ানমার থেকে চীনে সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন হ্যান্স ভ্রিয়েনস।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব যা হতে পারে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াঙ্গুনভিত্তিক এক ব্যবসায়ী বলছেন, সোমবার মিয়ানমারে হওয়া এই সামরিক অভ্যুত্থান শান্তিপূর্ণ হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছেন তিনি। তার মতে, ‘এখনও পর্যন্ত এটা শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। কোনো বিক্ষোভ হয়নি। কিন্তু মানুষ মর্মাহত।’

নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তার প্রভাব মিয়ানমারের অর্থনীতির ওপর পড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা হবে মূলত মানসিক। কারণ আমরা কখনোই পশ্চিমা বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল নই।’

তার মতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আলাদা কোনো ব্যবস্থা নিলে ফলাফল ভালো হবে।

আমেরিকান অ্যাপারেল ও ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট স্টিফেন লামার বলেন, ‘বিভিন্ন বাণিজ্যিক গ্রুপের সদস্যরা মিয়ানমারে ব্যবসা করেন এবং এই সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন।’

তার মতে, ‘সামরিক শাসন থেকে শান্তিপূর্ণ মুক্তির জন্য মিয়ানমারের জনগণের জন্য আমাদের প্রার্থনা থাকবে। এছাড়া মিয়ানমারের কঠোর পরিশ্রমী মানুষের হাতে অর্জিত অর্থনৈতিক উন্নতি কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না।’

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও এর পরের বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে বিশ্ববিখ্যাত ব্রান্ড এইচএন্ডএম’র এক মুখপাত্র বলছেন, সাপ্লায়ারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছি আমরা। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।

ধীরগতির প্রবৃদ্ধি
বিশ্বব্যাংক থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে মিয়ানমারের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ মন্থর গতিতে এগোবে। একইসঙ্গে দারিদ্র্যতার হারও ২২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

অর্থনৈতিক বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে কাজ করে ফিচ সল্যুশন। অনিতা বসু নামে এই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী বিবিসিকে বলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের আগে আগামী অর্থবছরে ৬ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন তা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে মনে হচ্ছে।

তবে অভ্যুত্থানের কারণে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব পড়বে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয় বলেও জানান তিনি।

সূত্র: বিবিসি

টিএম