অবশেষে গত ১আগস্ট প্রকাশিত হল ৪১তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার রেজাল্ট। এতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার প্রার্থীর মধ্যে ২১,০৫৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

এই লিস্টে যারা জায়গা করে নিয়েছেন, এই মুহূর্তে তারা নিশ্চই প্রফুল্ল ও উদ্বেলিত। উদ্বেলিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এতো প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে জায়গা করে নেওয়া ছোটখাটো বিষয় নয়। তবে ভুলে গেলে চলবে না, সামনে রিটেন ও ভাইভায় পাস করতে হবে। শুধু তাই নয়, রিটেন ও ভাইভায় ভালো নম্বর না পেয়ে কেবল পাস করলে ‌‘ক্যাডার’ পদটি নাও পেতে পারেন।

যদিও বিসিএস পরীক্ষার তিন ধাপের মধ্যে সবচেয়ে কঠিনতম ধাপ হল প্রিলি। কারণ, এই ধাপে অধিকাংশ প্রার্থী অকৃতকার্য হন। যেমন, ৪ লাখ ৭৫ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ২১,০৫৬ জন রিটেন পরীক্ষার জন্য ডাক পেয়েছেন। সেই হিসেবে পাসের হার ৪.৪৩২% মাত্র!

রিটেনে হয়তো এই ২১,০৫৬ জনের মধ্যে ৮-১২ হাজার ভাইভার জন্য ডাক পাবেন। মানে রিটেনে হয়তো ৪০-৫৫% পাস করবেন। তার মানে রিটেনে পাসের হার প্রিলির চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তবে, প্রিলি পরীক্ষা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় ধাপ হলেও রিটেন পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এর নম্বরের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে আপনার ক্যাডার / নন-ক্যাডার প্রাপ্তি। কারণ, প্রিলির নম্বর সাধারণ বিসিএসের ক্ষেত্রে যোগ হয় না। শুধু রিটেন ও ভাইভার নম্বর যোগ হয়। ভাইভা যেহেতু ২০০ নম্বরের, তাই আপনার মূল কাজটি সেরে ফেলতে হবে ৯০০ নম্বরের রিটেনেই। অন্যদিকে ২১,০৬৫ জন প্রিলিতে উত্তীর্ণ প্রার্থীর মধ্যে কেবল ২,১৬৬ জন ক্যাডার পাবেন। মানে প্রতি ১০জনে ১ জন ক্যাডার পাবেন, তাহলে আপনার রিটেন প্রস্তুতি কেমন হতে হবে নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেন। মনে রাখতে হবে, রিটেনে আপনাকে মোট ৯০০ নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৫০% নম্বর তথা ৪৫০ নন্বর পেতে হবে। আপনি যদি ৪৪৯ নম্বরও পান তাহলে আপনি রিটেনে ফেল! মানে আবার পরবর্তী বিসিএসের জন্য প্রিলি থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে!
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৪১তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখ ও সময়সূচী পিএসসি এত ওয়েবসাইটে ও প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দিবে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৪১তম বিসিএস নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ২৭ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে। ৪১তম বিসিএসে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হবে শিক্ষা ক্যাডারে, ৯০৫ জন। এর মধ্যে বিসিএস শিক্ষায় ৮৯২ জন প্রভাষক, কারিগরি শিক্ষা বিভাগে ১০ জন প্রভাষক নেওয়া হবে। শিক্ষার পর বেশি নিয়োগ হবে প্রশাসন ক্যাডারে। প্রশাসনে ৩২৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। পুলিশে ১০০ জন, বিসিএস স্বাস্থ্যতে সহকারী সার্জন পদে ১১০ জন ও সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে ৩০ জনকে নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ফেইসবুক গ্রুপে, পেইজে এমনকি আমার ‘BCS Preliminary Analysis’ অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে অনেকেই রিকুয়েস্ট করেছেন যেন বিসিএস রিটেন নিয়ে লিখি। আবার অনেকে বলেছেন, ‘শুধু প্রিলির পাস করার টিপস দেওয়া বেশিরভাগ মানুষ; কিন্তু রিটেন কীভাবে পাস করবো? রিটেন পাস করার তো তেমন টিপস পাই না! বিসিএস রিটেন নিয়ে ফেসবুকে তেমন লেখা দেখি না! ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘BCS Preliminary Analysis’ বইয়ের 4th Edition ও ‘শিক্ষক নিবন্ধন Analysis’ বইয়ের কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ সময় বের করে লিখেই ফেললাম!

আমি এখানে আমার বাস্তব জীবনের (৩৪তম-৩৭তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার) অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শেয়ার করার চেষ্টা করবো। এবার আসা যাক মূল কথায়। অনেকের ধারণা বিসিএস রিটেন অনেক কঠিন; প্রিলিতে কোনো মতে পাস করা গেলেও রিটেনে সহজে পাস করা যায় না!
আমি এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। আমার মতে প্রিলিতে পাস করা তুলনামূলক কিছুটা কঠিন। আর রিটেনে পাস করা তুলনামূলক সহজ প্রিলি চেয়ে। কারণ পিএসসি প্রিলিতে পাস করায় কম, কিন্তু রিটেনে ফেল করায় কম। অর্থাৎ, প্রিলির তুলনায় রিটেন অনেক গুণ বেশি পাস করে।

আপনাকে বিসিএস রিটেনে সহজে পাস করতে যা যা পড়তে হবে, তা হলো-

১। প্রথমে আপনি বিসিএস রিটেনের সিলেবাসটি মনোযোগ দিয়ে ২-৩ বার পড়ে বোঝার চেষ্টা করুন। বিসিএস রিটেন সিলেবাসটি বিপিএসসি এর ওয়েবসাইটে ও লিখিত পরীক্ষার যে কোনো নতুন বইয়ে পেয়ে যাবেন।

২। রিটেনের জন্য আগে বিগত সালের প্রশ্নগুলো ভালো করে পড়ুন। বিশেষ করে ৩৫তম-৪০তম পর্যন্ত। কারণ এগুলো নতুন সিলেবাসের আলোকে নতুন প্যাটার্নের প্রশ্ন।

৩। অর্থনৈতিক সমীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পড়ুন। বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকা পড়ুন বিশেষত সম্পাদকীয় পাতা। এতে আপনার বেশি নম্বর পেতে সহায়তা করবে।

৪। বাংলাদেশের বিষয়াবলীর সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ প্রতিদিন ৩-৫টা পড়ুন। এগুলো ভাইভাতেও কাজে দিবে।
সংবিধানের জন্য আরিফ খানের সহজ ভাষায় সংবিধান বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অথবা মোঃ আবদুল হালিম স্যারের ‘সংবিধান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতি’ বইটি পড়ে ফেলুন।

এইবার আসি বিষয়ভিত্তিক আলোচনা-

১। বাংলার জন্য  প্রফেসর'স/অ্যাসিওরেন্স লিখিত বাংলা বইটির পাশাপাশি ‘শীকর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ বা ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন। ব্যাকরণের ৩০ নম্বরের জন্য ৯ম-১০ম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বইটি পড়তে পারেন। আর বাংলা গ্রন্থ সমালোচনার জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক এবং উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন এর গ্রন্থ সমালোচনা পড়ে নিলেই হবে। এগুলো বিসিএস লিখিত বাংলা বইয়েই থাকে।

২। ইংরেজির জন্য প্রফেসর'স/অ্যাসিওরেন্স লিখিত ইংরেজি বইটির পাশাপাশি  ট্রান্সলেশনের জন্য ‘Saifur's Translation and Writing’ বইটি আমার কাছে বেস্ট মনে হয়েছে। সঙ্গে বেসিক বই হিসেবে PC Das এর Applied English Grammar and Composition বই ভালো সাপোর্ট দিবে ইংরেজির ক্ষেত্রে। ইংরেজিতে দুর্বল হলে আগে ‘BCS Preliminary Analysis’ বইয়ের grammar অংশ ভালোভাবে পড়তে হবে।

৩। গণিতের জন্য প্রফেসর'স/ওরাকল গণিত/অ্যাসিওরেন্স গণিত যে কোনো একটা, সঙ্গে ৯ম-১০ম শ্রেণির গণিত অনুশীলন করলে ভালো করতে পারবেন। পাশাপাশি বিসিএস সিলেবাস অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক গণিতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় পড়তে হবে।

৪। মানসিক দক্ষতার জন্য আগের বিসিএস রিটেন ও প্রিলির মানসিক দক্ষতার প্রশ্নগুলো কয়েকবার পড়ে নিবেন। বিগত সাল থেকে কমন আসে। এই ক্ষেত্রে শাহীন'স মানসিক দক্ষতা/প্রফেসর'স/ওরাকল গণিত/অ্যাসিওরেন্স কোনো একটা বই দেখতে পারেন।

৫। বিজ্ঞানের ও তথ্যপ্রযুক্তি এর জন্য ওরাকল বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বইটি ভালো লেগেছে আমার কাছে। প্রকৌশলী মুজিবুর রহমানের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির আইসিটি বইটি পড়লে তথ্য ও প্রযুক্তি অংশে ভালো সাপোর্ট পাবেন।

৬। বাংলাদেশ বিষয়াবলীর জন্য প্রফেসর'স/অ্যাসিওরেন্স লিখিত বইয়ের যে কোনো একটা ও প্রফেসর মোজাম্মেল হকের একাদশ শ্রেণির পৌরনীতি বইগুলো (বিশেষত দ্বিতীয় পত্র) ভালো কাজে দিবে। ড. আবু মো: দেলোয়ার স্যারের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ বইটি রাখতে পারেন (যা ভাইভাতেও কাজে দিবে)।

৭। আন্তর্জাতিক এর জন্য ড. তারেক শমসুর রেহমান স্যারের ‘বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর’, ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা ও সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি’ এবং শাহ মো: আব্দুল হাই এর ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংগঠন ও পররাষ্ট্রনীতি’ বইটি পড়তে পারেন।

প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে চাইলে আগে সিনিয়রদের কাছ থেকে (যারা বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন) লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন সংগ্রহ করে সবগুলো সমাধান করুন। অন্তত বিগত ১০ বছরের প্রশ্ন। এর পর সিলেবাস অনুযায়ী অনার্সের বই থেকে প্রস্তুতি নিন।

বিসিএস রিটেনে তথ্য-উপাত্ত প্রদানের ক্ষেত্রে যত বেশি গ্রাফ-চার্ট দেয়া যায় তত বেশি নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং তথ্য-উপাত্ত প্রদানের ক্ষেত্রে সেই তথ্য-উপাত্তের সূত্র তথা সোর্স উল্লেখ করবেন।

আর যাদের হাতের লেখা খারাপ বলে চিন্তায় আছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- চাকরির পরীক্ষায় আপনাদের লেখা সুন্দর নাকি অসুন্দর সেটা মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হলো আপনি কতটুকু কি লিখছেন সেটাই। আপনার যা খাতায় লিখেছেন তা পরীক্ষক  সহজে বোঝতে পারলেই হবে।

একটি বিষয় মনে রাখবেন, আপনি যদি কোনোভাবে বিসিএস প্রিলিটা পাস করতে পারেন তাহলে রিটেন ও ভাইভাতে যদি ভালো নম্বর পান তাহলে ক্যাডার নিশ্চিত! আর যদি রিটেন ও ভাইভাতে মোটামুটি নম্বরও পান তাহলে নন-ক্যাডারের মাধ্যমে সরকারি ফার্স্ট ক্লাস বা সেকেন্ড ক্লাস একটি জব পেতে পারেন কোনো প্রকার ঘুষ-তদবির ছাড়াই!

লেখক -
৩৫তম বিসিএস ক্যাডার, সাবেক সিনিয়র অফিসার (পূবালী ব্যাংক লিমিটেড)
প্রতিষ্ঠাতা : BCS Technique  (বিসিএস স্পেশাল প্রাইভেট প্রোগ্রাম)
লেখক: BCS Preliminary Analysis 
লেখক : প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ Analysis