রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের নাখালপাড়া এলাকায় সাবেক স্ত্রী ইয়াসমিনকে (৩০) খুনের আগে শ্যালিকা শিমু আক্তারকে (১৬) শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন রনি মিয়া (৩০)। পরে শিমুর মৃতদেহ কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখেন। এরপর রনি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে ইয়াসমিনের (৩০) অপেক্ষায় ওত পেতে থাকেন। দুপুরে খাবার খেতে বাসায় ঢুকলে ইয়াসমিনকে খুন করেন নির্মমভাবে।

এ ঘটনায় শনিবার (৯ জানুয়ারি) বিকেলে রনি মিয়াকে (৩০) আটক করে পুলিশ। পরে ১০ জানুয়ারি তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে হাজির করেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. শের আলম (নিরস্ত্র)। আসামি রনি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হওয়ায় তা রেকর্ড করার আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক রনির জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আমার মা তো ঘুমিয়ে গেছে।

৩ বছরের মেয়ে আদুরি।

রনির জবানবন্দি থেকে জানা যায়, তিনি জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার মোশারফগঞ্জ গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে। রনি পেশায় ভ্যানচালক।

জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. শের আলম বলেন, আসামি রনির সঙ্গে ইয়াসমিনের ২০০৮ সালে বিয়ে হয়। তাদের রোকসানা (১২) ও আদুরি (৩) নামে দুটি মেয়ে রয়েছে। ইয়াসমিন একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। কিন্ত তার স্বামী নির্দিষ্ট কোনো কাজ করতেন না। তিনি শুধু জুয়া খেলতেন। জুয়ার খেলার টাকা না দিলে ইয়াসমিন ও সন্তানদের মারধর করতেন। 

রনির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ৪ মাস আগে রনিকে ডিভোর্স দেন ইয়াসমিন। পরে দুই মেয়ে ও ছোটবোন শিমুকে নিয়ে নাখালপাড়া এলাকায় অন্য একটি বাসা ভাড়া নেন। গত এক সপ্তাহ থেকে তাদের বড়মেয়ে রোকসানা খালাম্মা বিথির বাসায় থাকছে। ছোটমেয়ে আদুরি তার নানার বাড়িতে আছে। 

২০০৮ সালে ইয়াসমিন ও রনির বিয়ে হয়। জুয়ার খেলার টাকা না দিলে ইয়াসমিন ও সন্তানদের মারধর করতেন রনি। 

গত ৯ জানুয়ারি ইয়াসমিনের ছোটবোন শিমু (নিহত) তার কর্মস্থলে ছুটি থাকায় বাসাতে ছিলেন। ওই দিন দুপুরে বন্ধ দরজা নক করার শব্দ শুনতে পান শিমু। তখন দরজা খুলে রনিকে দেখতে পান। দেখার সঙ্গে সঙ্গে শিমু দরজা লাগানোর চেষ্টা করেন। এ সময় রনি তাকে গলা চেপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। 

পুলিশ পরিদর্শক মো. শের আলম বলেন, শিমুকে হত্যার পরে তার মৃতদেহ কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখেন রনি। যাতে মনে হয় শিমু ঘুমিয়ে আছে। এরপর ইয়াসমিনকে হত্যার জন্য ঘরের ভেতরে বসে থাকেন তিনি। ইয়াসমিন দুপুরে কাজ থেকে খাবার খেতে বাসায় আসেন। 

রুমের ভেতরে বসে থাকা রনি তখন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেন। তিনি ইয়াসমিনের মাথা, কান, কপাল, গাল, ডান হাত ও ডান পায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করে গুরুতর জখম করেন। এভাবে খুন হন ইয়াসমিন। পরে তার ছোটবোন বিথী খবর পেয়ে ছুটে আসেন। পুলিশ মৃতদেহ হেফাজতে নেয় এবং রনিকে আটক করে। 

শিমুকে হত্যার পরে তার মৃতদেহ কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখেন রনি। এরপর ইয়াসমিনকে হত্যার জন্য ঘরের ভেতরে ওত পেতে বসে থাকেন।

এ ঘটনায় নিহতদের বোন সাথী আক্তার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ১০ জানুয়ারি দায়ের করা ওই মামলায় রনিকে একমাত্র আসামি করা হয়। 

তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, মামলাটির তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে আসামি রনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। রনিকে মামলা সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আসামি জামিনে মুক্তি পেলে পলাতক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে মামলার তদন্তে ব্যাঘাত ঘটবে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া আসামির নাম-ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। জবানবন্দি নেওয়ার পর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রনিকে হাজতে রাখা প্রয়োজন বলে তদন্ত কর্মকর্তা মনে করেন।

আমরা এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। খুনি রনির ফাঁসি চাই।

নিহতদের ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলাম।

নিহতের ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৮ সালে ইয়াসমিন ও রনির বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে রনি কোনো কাজকর্ম করতেন না। রনি তার স্ত্রী ইয়াসমিনের কাছ থেকে জুয়া খেলার টাকা-পয়সা নিতেন। টাকা না দিলে মারধর করতেন। এ কারণে তাদের ডিভোর্স হয়। কিন্তু ডিভোর্সের পর রনি চেয়েছিলেন তার সঙ্গে যেন আবারও ঘর-সংসার করে ইয়াসমিন। কিন্তু ইয়াসমিন তা মেনে না নেওয়ায়, আমার মনে হয় পরিকল্পিতভাবে রনি এই হত্যা করেন।

তিনি বলেন, আমরা এ হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। খুনি রনির ফাঁসি চাই।

ইয়াসমিনের দুই সন্তান রোকসানা ও আদুরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোকসানার তো ১২ বছর বয়স। সে তো কিছুটা বোঝে। সে বলে, তার বাবার ফাঁসি হোক। আর আদুরির মাত্র ৩ বছর বয়স। মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সে শুধু বলে, আমার মা তো ঘুমিয়ে গেছে।

নিহতদের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ইয়াসমিনের ৫ বোন, একভাই। মা-বাবার সংসারে ইয়াসমিন ছিলেন সকলের বড়। নিহত শিমু বোনদের মধ্যে চতুর্থ। নিহতরা নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার চর আড়ালিয়া গ্রামের ফটিক মিয়ার মেয়ে।

টিএইচ/এইচকে