হাইকোর্টের ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জে কথিত ধর্ষণ ও হত্যার শিকার স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘এই ঘটনাকে পুরো পুলিশ বাহিনীর গায়ে মাখানোর দরকার নেই। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবেই দেখা উচিৎ। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে তা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, সেটা পুলিশ বাহিনীকে ভেবে দেখা উচিৎ।’

বুধবার (১৩ জানুয়ারি) বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব কথা বলেন।

এ সংক্রান্ত শুনানির শুরুতে তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিচারিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পুলিশ বাহিনীর ওপর একটা দোষ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। তিনি তার আওতার মধ্যে থেকেই আসামি গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়েছেন। আসামিদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কারণ এ আসামিরা জুডিসিয়াল কমিটির বাইরে আর কারও কাছে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেননি।’

ভিকটিমকে (ভুক্তভোগী) মেরে নদীতে ফেলার যে জবানবন্দি তাতে আসামিদের স্বার্থ কী? এ দেশের মানুষ ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখতে চেয়েছিল। এ জন্য কি সকলেই ফাঁসিতে যেতে চায়! ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছে? জবানবন্দিতে আসামিরা মেয়েটি হত্যা করার কথা তাহলে কি শখ করে বলেছে? এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো হল এ দেশের জনগণ। আমরা বিচারপতি, আমরা এ মাটির সন্তান। আমরা সব কথা কোর্টে বলতে পারি না। এখানে সাংবাদিকরাও থাকেন।

হাইকোর্ট

তখন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভিকটিম বিচারিক কমিটির কাছে বলেছে, আসামি আবদুল্লাহ তাকে ধর্ষণ করেছে।’

আদালত বলেন, ‘২২ ধারার জবানবন্দিতে মেয়েটি আদালতে কি বলেছে? দুটি জবানবন্দির মধ্যে কোনটাকে আমরা ঠিক মনে করব?’

এ পর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সরোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘আসামিরা রিমান্ডের পর দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ওই জবানবন্দি দেওয়ার সময় তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্যাতনের কথা বলেনি।’

আপনাদের দুজনের শুনানি গ্রহণ করলে আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বলে ধরে নিতে হয়। নারায়ণগঞ্জের এই একটি ঘটনাকে পুরো পুলিশ বাহিনীর গায়ে মাখানোর দরকার নেই। বিছিন্ন ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবেই দেখা উচিৎ। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে তা থেকে কীভাবে উত্তোরণ করা যায়, সেটা পুলিশ বাহিনীকে ভেবে দেখা উচিৎ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও যদি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে কোনো কটু কথা বলা হয় তাহলে সেটা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।

হাইকোর্ট

আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে, সেজন্য জুডিসিয়াল প্রতিবেদনে তার প্রশংসাও করা হয়েছে। এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করছি।’

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, ‘ভারতে কোনো আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হলে সেখানে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে। সেজন্য তারা সিআরপিসি সংশোধন করেছে। আমরা তো কোর্ট থেকে আইন সংশোধনের কথা বললে নানান প্রতিক্রিয়া হয়।’

আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্ট মামলার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘এই মামলায় রিমান্ডে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে।’

এই মামলাটি এখন রিভিউ বিচারাধীন রয়েছে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগকে এ বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আপনারা (হাইকোর্ট) আইন সংশোধনের নির্দেশনা না দিয়ে শুধু পর্যবেক্ষণ দিতে পারেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন মানিক

তখন আদালত বলেন, ‘হাইকোর্টের কাজ কি তাহলে রুল মঞ্জুর, রুল খারিজ করা আর জামিন দেওয়া?’

এদিকে, এই মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী বুধবার দিন ধার্য করেন। ওইদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনবেন আদালত।

এর আগে, ৪ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে কথিত ‘ধর্ষণ ও হত্যার শিকার’ স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিদের ভয় দেখিয়ে ও মারধর করে কিশোরীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করার স্বীকারোক্তি নেয় পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে ২৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়।

গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে কথিত ‘ধর্ষণ ও হত্যার শিকার’ স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

গত বছরের ২৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে ‘ধর্ষণ ও হত্যার শিকার’ স্কুলছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় নথি তলবের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন দায়ের করা হয়। পাঁচ আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির এ আবেদন দায়ের করেন।

ওই পাঁচ আইনজীবী হলেন- মো. আসাদ উদ্দিন, মো. জোবায়েদুর রহমান, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. আল রেজা আমির এবং মো. মিসবাহ উদ্দিন।

গত বছরের আগস্টে ‘ধর্ষণের পর নদীতে লাশ ফেলে দেয়া স্কুলছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ওই প্রতিবেদনে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সোমবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। তখন আদালত আইনজীবী শিশির মনিরকে লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেন। এরপর মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) একটি রিভিশন মামলা দায়ের করা হয়।

ঘটনার বিবরণী উল্লেখ করে শিশির মনির জানান, গত ৪ জুলাই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী দিসা নিখোঁজ হয়। গত ৬ আগস্ট নিখোঁজ দিসার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলার পর পুলিশ আব্দুল্লাহ, রকিব এবং খলিল নামে তিন জনকে গ্রেপ্তার করেন। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। 
স্বীকারোক্তিতে তারা বলেন যে, তারা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী দিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। জবানবন্দি গ্রহণের পর আসামিদেরকে জেলে পাঠানো হয়।

কিন্তু ২৩ আগস্ট দিসাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশের হেফাজতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আসামিরা কীভাবে ধর্ষণ ও হত্যা সম্পর্কিত স্বীকারোক্তি দিয়েছে। যেখানে দিসা অক্ষত অবস্থায় ফেরত এসেছে।

এমএইচডি/এফআর