স্বামী সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল আফজাল হোসেনের সঙ্গে ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা

সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল আফজাল হোসেন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা। আফজাল হোসেন ছোটবেলা থেকে ছিলেন তুখোড় মেধাবী। পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। অন্যদিকে, সাঈদা শারমিন এশা ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হন ভূঁইয়া একাডেমিতে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে আইনে গ্রাজুয়েশন শেষে পাড়ি দেন লন্ডনে। ২০১১ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে এসে আইন পেশা শুরু করেন। সেনা কর্মকর্তা স্বামীর অনুপ্রেরণায় এশা উচ্চ আদালতের বিচারপতি হতে চান। পথশিশুদের অধিকার নিশ্চিতে রাখতে চান বিশেষ অবদান। 

সম্প্রতি নানা বিষয়ে কথা হয় ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম। 

সোনালি দিনগুলো... 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ঢাকায় বসবাস। গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। বাবা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় নাচ-গান শিখতে শিশু একাডেমিতে ভর্তি হন। ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে ওঠার পর সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। ব্যারিস্টার হওয়ার আশায় ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে ভূঁইয়া একাডেমিতে। ২০০৯ সালে এলএলবি শেষ করে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। ২০১০ সালে নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়াল 'ল' এর ওপর এলএলএম শেষ করেন। ২০১১ সালে সম্পন্ন করেন বার অ্যাট ল কোর্স। 

দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা। বড় ভাই বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। এখন সেখানেই চাকরি করেন তিনি। ভাবিও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএচডি করে ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে আছেন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা

ঢাকা পোস্ট : আপনার স্বামী লে. কর্নেল আফজাল হোসেন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন... 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : আমার স্বামীর জন্ম চট্টগ্রামে, ১৯৮৩ সালে। বাবা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। বাবার পোস্টিংয়ের কারণে দেশের অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে তাকে। আফজাল ১৯৯৫ সালে পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকে এসএসসি ও এইচএসসিতে বোর্ড স্ট্যান্ড করে। এরপর নিজের ও পরিবারের ইচ্ছায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আফজাল সবার ছোট। তার বড় বোন সপরিবারে কানাডায় থাকেন। ছোট বোন ও দুলাভাই পেশায় চিকিৎসক, থাকেন ঢাকায়। 

ইংল্যান্ডের দিনগুলো... 

ছোটবেলা থেকেই খুব কড়া শাসনে বড় হয়েছি। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় আদরও পেয়েছি বেশ। যখন ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে গেলাম পড়াশোনার জন্য, শুরুতে অনেক কষ্ট হয়েছে। রান্না করতে গিয়ে আম্মুর কথা মনে পড়ত আর কান্না আসত। আমার ইউনিভার্সিটির ডরমিটরি থেকে মসজিদ কাছে ছিল। বেশি খারাপ লাগলে শুক্রবার সেখানে গিয়ে নামাজ পড়তাম। যদিও এর আগে দেশে থাকা অবস্থায় কখনও মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া হয়নি। সবসময় একটাই চিন্তা ছিল, একবারে কোর্স শেষ করে দেশে চলে যাব। পড়াশোনা শেষে ২০১১ সালের ২৮ জুলাই দেশে ফিরে আসি। দুই বছরে ইংল্যান্ডের অনেক জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। 

আইনজীবী হিসেবে যাত্রা... 

আব্বুর ইচ্ছাতেই আইন পেশায় আসা। ব্যারিস্টারি পাস করে এসে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম স্যারের চেম্বারে জয়েন করি। স্যারের চেম্বারে কাজের পরিবেশ ছিল দারুণ। চেম্বারে বইয়ের কালেকশন ছিল অন্য রকম। এক বছর ওই চেম্বারে ছিলাম, কিন্তু এত বছর পরও স্যার আমাদের (জুনিয়র) উনার সব অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন। 

আমীর-উল-ইসলাম স্যারের চেম্বারে এক বছর ছিলাম। পরে ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ ফারুক স্যারের চেম্বারে দুই বছর কাজ করি। সত্যিকার অর্থে, ইমতিয়াজ স্যারের চেম্বারে আসল কাজটি করার সুযোগ পেয়েছি। স্যারের কাছ থেকে দুই বছরে মনে হয় পাঁচ বছরের কাজ শিখেছি। মেটার্নিটির জন্য মাঝখানে এক বছর কাজ থেকে বিরত ছিলাম। তারপর গত পাঁচ বছর ধরে লেজ কাউন্সিলে আছি ব্যারিস্টার মেজবাহুর রহমান শুভ স্যারের সঙ্গে। সঙ্গে আমার নিজেরও চেম্বার আছে। 

২০১৩ সালে জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে এনরোলমেন্ট (তালিকাভুক্তি) হই। ২০১৫ সালে হাইকোর্টে এনরোলমেন্ট হয়। আমি মূলত সিভিল ম্যাটার, রিট পিটিশন, কোম্পানি ম্যাটার, অ্যাডমিরালটি ম্যাটার, আরবিট্রেশন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করি। একটি কথা না বললেই নয়, চেম্বার করা, কোর্ট করা, আবার নিজের ছেলেকে সময় দেওয়া, নিজের ক্লায়েন্ট ডিল করা— সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র আমার সিনিয়রদের সহযোগিতায়। এরপর আর্মি অফিসারের ওয়াইফ হিসেবেও কিছু কাজ করতে হয়। সবকিছু সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে আমার সিনিয়র ও পরিবারের সাপোর্টের কারণে। 

ঢাকা পোস্ট : কোন সিনিয়রের সাবমিশন ভালো লাগে আপনার? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : কোর্টে সিনিয়র যারা আছেন অনেকেরই সাবমিশন ভালো লাগে। প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্যারের শুনানি অসাধারণ লাগত। কামরুল হক সিদ্দিকী স্যারের সাবমিশনও খুব ভালো লাগে। এত সিনিয়র হয়েও তিনি জুনিয়রদের সঙ্গে দারুণ ব্যবহার করেন। 

ঢাকা পোস্ট : আইন পেশায় কোন নীতি অনুসরণ করেন আপনি? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : ক্লায়েন্টরা তো আজকাল আইনজীবীদের চেয়েও স্মার্ট। দেখা যায়, এক আইনজীবীর কাছ থেকে মতামত নিয়ে অন্য আইনজীবীর কাছে চলে যান তারা। আমার হাজব্যান্ড (স্বামী) বলে, ক্লায়েন্টরা দেখেন কোন আইনজীবী তার জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করছেন। আমার কাছে মনে হয়, বেশির ভাগ মামলায় হাইকোর্ট থেকে রায় হয়ে যাওয়ার পর আপিল বিভাগে যে ফাইল হয়, সেটা নিয়ম রক্ষার্থে হয়।

ঢাকা পোস্ট : আইন পেশায় নারী হিসেবে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কি না? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : আল্লাহর রহমতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। কোর্টের পরিবেশ দিনদিন ভালো হচ্ছে। পরিবেশ আরও নারীবান্ধব হবে বলে আশা করছি। এটি যদি আরও ভাল হয় তাহলে অনেক মেয়ে কোর্টে আসবেন। আমার সঙ্গে অনেক মেয়ে ভালো রেজাল্ট করে বের হয়েছেন। তারা এখনও কোর্টে প্র্যাকটিসের জন্য আসেননি। বাসার সাপোর্টের সঙ্গে চেম্বারের সাপোর্টও খুব দরকার হয়। ওটা হলে মেধাবীরাও আইন পেশায় আসবেন।

ঢাকা পোস্ট : লে. কর্নেল আফজাল হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে সম্পর্কে যদি বলতেন... 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়। ইংল্যান্ড থেকে বার অ্যাট ল শেষ করে আসার পর আমার জন্য কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। এর মধ্যে আফজালকে দেখে আমার বাবার খুব পছন্দ হয়। ২০১৩ সালে আমাদের বিয়ে হয়। আমাদের একমাত্র ছেলে আয়ান আফজাল। সানিডেল স্কুলে কেজি টু-তে পড়ে। 

ঢাকা পোস্ট : দুজন ভিন্ন পেশার মানুষ, সংসার ও কাজের সমন্বয় করেন কীভাবে? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : আমার কাছে তো মনে হয়, আমি দুই রকম লাইফ লিড করি। কারণ, যখন আমি ক্যান্টনমেন্টে থাকি তখন আমি আর্মি অফিসারের ওয়াইফ। অফিসারের ওয়াইফ হিসেবে যেসব দায়িত্ব থাকে, সিনিয়রদের সঙ্গে জুনিয়রদের সেগুলো আমি পালনের চেষ্টা করি। আর যখন আমি আমার কাজে কোর্টে থাকি অথবা চেম্বারে থাকি, তখন সব মনোযোগ থাকে আমার কাজের প্রতি। 

ঢাকা পোস্ট : স্বামী আর্মি অফিসার, এটা কেমন লাগে? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : এটা আমার কাছে খুবই গর্বের বিষয়। তার কাছে দেশ আগে, তারপর পরিবার। 

ঢাকা পোস্ট : নিজ পেশায় সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে চান। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পান? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : আব্বু ছাড়াও আমার শ্বশুর ও হাজব্যান্ড আমাকে নিয়ে খুবই আশাবাদী। শ্বশুরও চান আমি যেন আমার প্রফেশনে ভালো করি। আমার হাজব্যান্ডও অনেক সহযোগিতা করে। আমি যেহেতু একটু ইন্ট্রোভার্ট (অন্তর্মুখী) টাইপের, এ কারণে সে সবসময় আমাকে এক্সট্রোভার্ট (বহির্মুখী) হওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়। আমি আমার নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে যতটুকু প্রত্যাশী, আমার হাজব্যান্ড তার চেয়ে বেশি প্রত্যাশী। নিজের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে সবসময় উৎসাহ দেয় সে। 

ঢাকা পোস্ট : সাফল্যের চূড়ায় উঠতে চান বললেন, সেটা কত দূর? 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : আমার তো ইচ্ছা বিচারপতি হওয়ার। মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি নাইমা হায়দারকে দেখে অনুপ্রাণিত হই। তাদের বিচারকাজ পরিচালনা দেখে আমারও ইচ্ছা বিচারপতি হওয়ার। উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা কম। এ কারণেই বিচারপতি হওয়ার সুপ্ত বাসনা লালন করি। 

ঢাকা পোস্ট : যারা আইন পেশায় আসতে চান তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন... 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : আইন তো সারাজীবন চর্চার একটা প্রফেশন। অনেক ধৈর্য লাগবে এবং অনেক জ্ঞানের সাধনা করতে হবে। যারা এটা করতে পারবে তারাই এ প্রফেশনে সফল হবে। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ, এ পেশায় নিজেকে দাঁড় করাতে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। আমার মতো যাদের পরিবারে আগে কখনও আইনজীবী ছিল না তাদের জন্য এটি একটু কষ্টকর বিষয়।  

আমার কাছে মনে হয়, শুরুতে জুনিয়রদের যে ফি দেওয়া হয় সেটা আসলে কম। এছাড়া, নিজের প্রফেশনকে সম্মান করতে হবে। বিচারপতির সম্মানটা আসলে তার চেয়ারের সঙ্গে আসে। আমাদের যে ব্র্যান্ড বা যে পোশাক, সেটার সম্মান আমাদের নিজেদেরই রাখতে হয়। এখন আইনজীবীর পোশাক পরে যদি কেউ বাজারঘাটে চলে যান বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠেন, তাহলে সেটা দৃষ্টিকটু দেখায়। তাই নিজের প্রফেশনের সম্মানটা নিজেকেই রাখতে হবে। 

ঢাকা পোস্ট : ভবিষ্যতে পথশিশুদের দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। একটু যদি ব্যাখ্যা করতেন... 

ব্যারিস্টার সাঈদা শারমিন এশা : রাস্তায় যেসব ছোট ছোট বাচ্চা থাকে, তাদের দেখলে খুবই কষ্ট হয়। মনে হয়, আমার ছেলের মতোই তারা, রাস্তাতেই জন্ম নিচ্ছে, ওই রাস্তাতেই বড় হচ্ছে; রাস্তাই তাদের সবকিছু। সমাজ আসলে তাদের যা দিচ্ছে, তারা সমাজকে তা-ই ফেরত দিচ্ছে। এগুলো দেখলে খুব কষ্ট লাগে। 

আসলে একটা বাচ্চার পেছনে মাসে কত টাকাই-বা খরচ হয়, পড়ালেখা আর খাওয়ার জন্য! সেখানে পাঁচটা বা ১০টা বাচ্চার দায়িত্ব যদি নেওয়া যায় তাহলে তারা সমাজের বোঝা হয়ে থাকত না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত। এমন ভাবনা থেকে কিছু পথশিশুর দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা আছে। 

এমএইচডি/এসকেডি/এমএআর/এইচকে