জিনাত জাহান। আমেরিকার নিউইয়র্ক কোর্টের অ্যাটর্নি। বাবা বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। জিনাতের  শৈশব-কৈশোর কেটেছে সিলেটে। সিলেটের আনন্দ নিকেতন স্কুল থেকে ও- লেভেল পাস করে ঢাকা চলে আসেন। ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে আইনে ভর্তি হন। সেখান থেকে  গ্রাজুয়েশন শেষ করে পাড়ি জমান লন্ডনে। ইংল্যান্ডের নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে বিপিটিসি কোর্স করে লিংকন ইন থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর জিনাতের জীবনের বাঁক বদলে যায়। ২০১৬ সালে চলে যান স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়।  নিউইয়র্কের ব্রুকলিন  স্কুল অব ল’ থেকে আইনে  মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে বার পরীক্ষায় অংশ নেন। বার পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে অ্যাটর্নি পদবী লাভ করেন। এখন নিউইয়র্কের কোর্টে আইনপেশা পরিচালনা করে যাচ্ছেন বিচারপতি বাবাকে দেখে ছোট বেলা থেকে কালো কোর্টের প্রতি আকৃষ্ট জিনাত জাহান।

সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। সেই সুবাদে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন। শৈশব-কৈশোরের সোনালী দিন, বিচারপতি বাবা, ব্যারিস্টারি ডিগ্রি, দেশ নিয়ে ভাবনাসহ না বলা গল্পগুলো বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।

ঢাকা পোস্ট: আপনার শৈশব-কৈশোর,পড়ালেখা বিষয়ে জানতে চাই..

জিনাত জাহান: আমার জন্ম সিলেটে। বাবা খিজির আহমেদ চৌধুরী। তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। মা সুগৃহিনী। শৈশব-কৈশোর সিলেটেই কেটেছে। সিলেটের আনন্দ নিকেতন স্কুল থেকে ২০১০ সালে ও-লেভেল  পাস করি। এটা সিলেটের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সবচেয়ে নামকরা। ২০১১ সালে ঢাকায় এসে এ- লেভেল শেষ করি।  এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজে (এলসিএলএস) আইনে অনার্স ভর্তি হই। এলসিএলএস থেকে এলএলবি গ্রাজুয়েশন করি। তারপর ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে চলে যাই। নর্দাম্মিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে বিপিটিসি (বার ভোকেশনাল ট্রেনিং কোর্স) শেষ করি। ২০১৬ সালে লিংকন ইন থেকে কল টু দ্যা বার নেই। ওই বছরই আমেরিকায় চলে যাই। ২০১৮ সালে আমেরিকায়  আইনে  মাস্টার্স শেষ করি।  আমরা দুই  বোন। বড় বোন ডাক্তার। উনিও আমেরিকায় আছেন। বোনের নাম রওনক জাহান।

বাবা মায়ের সাথে জিনাত জাহান

ঢাকা পোস্ট: আইন পড়ার আগ্রহটা কীভাবে এলো?

জিনাত জাহান: আমরা তখন সিলেটে। বাবা সিলেট বারের আইনজীবী ছিলেন। ছোট বেলাতে বাবা কোর্টে যাওয়ার আগে চেষ্টার করতাম তার সঙ্গে বের হয়ে যাওয়ার। আমার খুব ভালো লাগতো বাবা কোথায় যাচ্ছেন তা দেখার। আমার মনে আছে একদম ছোট থাকতে একদিন বাবার সঙ্গে একবার সিলেট কোর্টে গিয়েছিলাম। সেদিন প্রথম কোর্টের প্রসিডিং দেখেছিলাম। আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। মনে হচ্ছিল সিনেমার দৃশ্য দেখছি। বাস্তব জীবনে যে এ রকম হয় তা জানতাম না। বাবার সঙ্গে কোর্টে গিয়ে প্রথম দেখেছি। ওই সময় থেকে কালো কোটের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়।

ঢাকা পোস্ট: বাবার কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করেছে কি না?

জিনাত জাহান: ডেফিনেটলি। বাবা যে কালো কোট পরে আদালতে যাচ্ছেন ওটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো। আমাদের বাসার পাশে ছিল বাবার চেম্বার। বাবা চেম্বারে কাজ করতেন। আইন পেশায় ব্যস্ত থাকতেন। আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে টাইপ করে দিতাম।  একটা সময় এমন হলো বাবা আমাকে স্কুলে থেকে নিয়ে কোর্টে চলে আসতেন। বাবার সঙ্গে লাঞ্চ করে বাসায় চলে আসতাম। বাবাকে দেখেই আইনপেশার প্রতি ভালোবাসা গড়ে  উঠে। তবে বাবা কখনও বলেনি, তুমি এই পেশায় আসো। নিজে থেকেই বেছে নিয়েছি।  একদম ছোটবেলা থেকে আমি জানতাম- আমি বার করব, ব্যারিস্টার হব। অল্টারনেটিভ কোন চিন্তা করি নাই কখনও। এরপর আমি যখন আইন পড়া শুরু করলাম তখন তো নিজের ইচ্ছা থেকেই বাবাকে সহযোগিতা করতাম, চেম্বারে কাজ করতাম। সকালে বা রাতে বাবাকে হেল্প করতাম। এতে আমার দুটো লাভ হতো। বাবার সাথে টাইম এক্সপেন্ড করাও হতো, আবার মনে হতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু তো করছি। এভাবে ধীরে ধীরে আইন পেশা রক্তের সঙ্গে মিশে যায়।

জিনাত জাহান

ঢাকা পোস্ট: বাবার কোন উপদেশ সামনে পথ চলতে সাহস যোগায়?

জিনাত জাহান: বাবা সরাসরি কোনো উপদেশ দেন না। মনে করেন আমার কোনো বন্ধুর সঙ্গে কোনো সমস্যা হলো। বাবা কখনও আমার পক্ষ নেন না। তিনি বরং আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দেন, সংশোধন হতে বলেন। আমি কোনো অন্যায় করলে কখনও তা সাপোর্ট দেন না। সব সময় ফেয়ার থাকতে বলেন। আগে রাগ হতো মনে হত বাবা আমার পক্ষ নিচ্ছেন না কেন। এখন মনে হয় বাবা সঠিক ছিলেন। তার ভূমিকার কারণেই আমরা ভালো জায়গায় যেতে পেরেছি। এখন আমরাও নিজের মানুষ হলেই তার পক্ষ নেই না। ভালো-মন্দ বিচার করে চলি। বাবার মনোভাবটা সব সময় মাথায় থাকে। এখনও কিছু হলে বাবাকে বলার আগে চিন্তা করি,মনে মনে ভাবি বাবাকে বলে লাভ হবে কি না। কারণ তিনি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থাকেন। আর আমার মা নীরবে আমাদের জন্য কাজ করে যান। আমাদের দুই বোনের সাফল্যের নেপথ্যে মায়ের অনেক অবদান।

ঢাকা পোস্ট: আমেরিকায় আইনপেশা শুরুর গল্প শুনতে চাই…

জিনাত জাহান: আমার ফুফু অনেক আগে থেকে আমেরিকার ইমিগ্রান্ট। তিনি আমাদের জন্য আগে আবেদন করে রেখেছিলেন। ২০১০ সাল থেকে আমরা ইমিগ্রান্ট হয়ে আমেরিকা যাওয়া-আসার মধ্যে থাকতাম। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি শেষ করে আমেরিকায় মুভ করি। পরিকল্পনা ছিল  আমেরিকাতে   প্র্যাকটিস করব। সো আমি নিউইয়র্ক বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের   সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের বললাম আমি তো ইউকে থেকে বার এট ল‘ করে এসেছি। এখন আমার কী করতে হবে। ওরা আমাকে আমেরিকায় একটা মাস্টার্স করার পরামর্শ দিল।  তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি নিউইয়র্কের ব্রুকলিন  স্কুল অব ল’ থেকে মাস্টার্স করি। তারপর আমি নিউইয়র্কে বার পরীক্ষা দেই। ২০১৯ সালে আমার বার পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় পাস করে আমি অ্যাটর্নি পদবী লাভ করি। সেকেন্ড ডিভিশনে প্র্যাকটিসের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত  হই। হাউজিং, ফ্যামিলি ম্যাটার এই কোর্টে বিচার হয়। এখন আমি নিউইয়র্কের হাউজিং কোর্টে অ্যাটর্নি হিসেবে আইন পেশা পরিচালনা করছি। নিউইয়র্ক সিটির সুপ্রিম কোর্টে আমি প্র্যাকটিস করতে পারব।

ঢাকা পোস্ট: আপনার দৃষ্টিতে দুই দেশে আইনপেশা পরিচালনার পার্থক্যটা যদি বলতেন?

জিনাত জাহান: আমি মনে করি আমেরিকায় জুনিয়রদের মামলা পরিচালনা করাটা এদেশের চেয়ে আরেকটু সহজ। এদেশে যেমন জুনিয়রদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়, আমেরিকায় তা করতে হয় না। আমার এক বছর হয়েছে লাইসেন্সের। এর মধ্যে আমি  শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারছি।  বিচারপতিদের সঙ্গে কথা বলছি।  ফ্রি ডায়লগ আছে ওখানে। সবার সমান সুযোগ। আমার সিনিয়র আছেন ডেফিনেটলি। উনি আমার শুনানিতে সঙ্গে থাকছেন। কিন্তু কোর্টে মেইনলি শুনানি করব আমি। আমি যদি কিছু ভুলে যাই তখন মনে করিয়ে দিচ্ছেন। জাজদের সামনে মূল শুনানিটা জুনিয়র করছেন। আমি মনে করি এতে জুনিয়রদের ডেভেলপ করাটা আরও সহজ হয়। আপনি যত প্র্যাকটিস করবেন তত আপনার অভিজ্ঞতা বাড়বে। আপনি যদি  মনে  করেন ৫ বছর পর আমি এপিয়ার করব, তাহলে ওই ৫ বছর কিন্তু আপনার গ্রোথ হচ্ছে না। প্রথম থেকেই নতুনদের মামলা পরিচালনা দেওয়ার  সুযোগটা আমি এপ্রিশিয়েট করি।

আরেকটি বিষয় ভালো লাগে, আমেরিকায় শুধু গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো শুনানির জন্য শুধু জাজের সামনে উপস্থাপন করা হয়। কোনো মামলা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে কোর্ট অ্যাটর্নি যারা থাকেন তারাই সমাধান করে দেন। এতে মামলাজট এড়ানো যায়।

ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছেন জিনাত জাহান

ঢাকা পোস্ট: নিউইয়র্ক কোর্টে শুনানির কোনো অভিজ্ঞতা বলুন?

জিনাত জাহান: আনফরচুনেটলি আমি প্যানডেমিকের সময় থেকে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। ভার্চুয়ালি আমাকে শুনানিতে অংশ নিতে হয়েছে। কিছু দিন আগে আমি একটি শুনানিতে অংশ নিয়েছিলাম ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ৩টার সময়। ওইখানে তো তখন দুপুর দেড়টা। আমি এটা কখনও চিন্তা করিনি ঢাকা থেকে আমি শুনানি করব। এটা একটা অভিজ্ঞতা। আমি যে ল’ ফার্মে কাজ করি সেটা নন প্রফিট। নাম লিগ্যাল সার্ভিস অ্যান্ড এডভাইজিং।  আমরা ক্লায়েন্টের প্রবলেম আদালতে তুলে ধরি। হাউজিং, ফ্যামিলি ম্যাটার নিয়ে কাজ করি। আরেকটি কথা, অ্যাটর্নি হিসেবে সনদ লাভের আগ থেকে আমি কোর্টে কাজ করতাম। সেই সুবাদে অনেক বিচারকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। তাদের বলেছিলাম, আমি বার পরীক্ষা দিচ্ছি। উনারা আমাকে সব সময় উৎসাহ দিতেন। যখন শুনলেন, আমি পাস করেছি, তখন তারা নিজে থেকে ডেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। একজন বিচারক আছেন তার সঙ্গে আমি অ্যাটর্নি হওয়ার আগে কাজ করতাম। উনি সব সময় আমাকে উৎসাহ দিতেন। এখন আমি তার কোর্টে শুনানি করি। এটা খুব ভালো লাগে। তিনিও আমাকে উৎসাহ দেন।

ঢাকা পোস্ট: জীবনের স্মরণীয় বা আনন্দের ঘটনা বলুন?

জিনাত জাহান: আমি যখন ইউকে থেকে বার-এট ল’ কমপ্লিট করি সেটা খুবই আনন্দের ছিল। এটা আমার বড় একটা অর্জন বলে মনে করি। এরপর নিউইর্য়ক বারে যখন অ্যাটর্নি হিসেবে তালিকাভুক্ত হই সেটাও আনন্দের। ছোটবেলা থেকে আত্মীয় স্বজন সবাই বলতো উকিলের মেয়ে ব্যারিস্টার হবে। স্কুল থেকেই মনের মধ্যে স্বপ্ন গেঁথে যায়। সো ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করাটা আমার জন্য বেশি আনন্দের ও স্মরণীয় ছিল।

ঢাকা পোস্ট: যারা আইন পড়তে চায় তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন?

জিনাত জাহান: আমি   বলবো আইনপেশা  অত্যন্ত সন্মানজনক একটি পেশা। এই পেশা থেকে পারসোনাল লেভেলে হোক, ন্যাশনাল লেভেলে হোক  বড় একটি ইমপ্যাক্ট তৈরি করা সম্ভব। যেমন বাবা এক সময় ল’ প্র্যাকটিস করতেন এখন বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন। এই ধারাবাহিকতা থাকবে। এই রকম ক্যারিয়ার যদি কেউ গঠন করেন এটা তো বড় বিষয়।  তবে এ পেশা ইজি না। পরিশ্রম করতে হবে। আইনপেশায় আসতে আমি ইনকারেজ করবো ডেফিনেটলি। কেউ যদি ইংল্যান্ড থেকে বার করে নিউইয়র্কে প্র্যাকটিস করতে চায়,আমি তাদের উৎসাহিত করবো। আমার সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেন। আমি মনে করি আইন পড়ে শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী কাজ করার সুযোগ আছে।

ঢাকা পোস্ট: দেশ নিয়ে ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা…

জিনাত জাহান: যখন আমি আমেরিকার কোর্টে কোনো মামলায় আইনি লড়াই করি, তখনও দেশের কথা মনে থাকে। মনে হয় আমি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি যখন ভালো সাবমিশন রাখি, মনে হয় বাংলাদেশ থেকে পড়াশুনা করে আমেরিকার কোর্টে ভালো করছি। তখন সেটা দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনে। ভবিষ্যতে দুই দেশেই আইন পেশা পরিচালনার ইচ্ছে আছে। পরবর্তী ৫ বছরের জন্য আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, যত পারব আমি রিসার্চ করবো, যত পারব আমি শিখবো। নিজেকে বিল্ডআপ করাই আপাতত লক্ষ্য। আইন পেশায় অনেক দূর যেতে চাই। এ পেশার মাধ্যমে মানুষের সেবা করতে চাই।

এমএইচডি/এসএসএইচ/এসএম