বাঙালি নারীর প্রধান পোশাক হলো শাড়ি। শাড়ি ছাড়া তাদের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে না যেন। যেকোনো উৎসবে-পার্বণে নারীর প্রথম পছন্দ হলো শাড়ি। শাড়ির আবার আছে অনেক ধরন। তার মধ্যে অন্যতম হলো জামদানি। এই শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। জামদানি শাড়ি তুলা দিয়ে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের শাড়ি। মসলিনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় শাড়ি জামদানি। জামদানি শাড়ির বয়নে ৭০ থেকে ৮০ কাউন্টের তুলা ব্যবহার করা হয়। বাঙালি নারীদের কাছে প্রাচীনকালের মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয় জামদানি শাড়ি।

জামদানি শাড়ির নামকরণ নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, জামদানি শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি ভাষায় জামা অর্থ কাপড় আর দানা অর্থ বুঁটি। একসঙ্গে যার অর্থ বুঁটিদার কাপড়। জামদানি শাড়িতে অসংখ্য বুঁটি দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, ফারসি জাম অর্থ মদ আর দানি অর্থ পেয়ালা। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনে মসলিন কাপড় থাকার কারণে এই ধারণার উৎপত্তি হয়েছে।

নকশা ভেদে জামদানির বিভিন্ন নাম রয়েছে। তেরছা, জলপাড়, পান্না হাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলা ফুল, আঙ্গুরলতা, ময়ূরপ্যাচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুঁটিদার, ঝালর, ময়ূরপাখা, পুইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, প্রজাপতি, জুঁইবুঁটি, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুলসহ আরও অনেক। মসলিনের হাত ধরে জামদানির বেড়ে ওঠা। বাংলার মধ্যযুগে মসলিন ছিলো সবচেয়ে মূল্যবান কাপড়। পরবর্তীতে বাংলায় মসলিন কাপড় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও জামদানির পথচলা শুরু হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, মসলিন কাপড় নিজ দেশে আমদানির পর যাতে ভারতে আর মসলিন কাপড়ের কোনো কারখানা গড়ে না ওঠে সেই কারণে ব্রিটিশরা কাপড়টির উৎপাদনকারীদের আঙুল কেটে দেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মসলিন কাপড়ের দাম ছিলো ২৫০ টাকা। ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলায় ভালো মানের মসলিনের দাম ছিলো ৪৫০ টাকা। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়িসহ অন্যান্য অঞ্চল মসলিন কাপড় উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো। পরবর্তীতে মসলিন কাপড় বিলুপ্তির পথ ধরে বাংলায় জামদানি কাপড় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

জামদানি হলো এক ধরনের কাপড় যেখানে ফুল বোনা থাকে। সাধারণত যেসব কাপড়ে ফুল বোনা হয় সেসব কাপড়কে মসলিন বলা হয়। বিচিত্র কারুকার্যে খচিত মসলিনের নাম জামদানি। তোফায়েলের ‌‌‌‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’ বইয়ে জামদানির সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়- ‘সুখের বিষয় আজও জামদানির প্রচলন রয়েছে বলে অল্পবিস্তর সবাই আমরা এই বস্তুর সঙ্গে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে জামদানিই সবচেয়ে পুরনো তাঁত যার এখন অবধি কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। তবে জামদানির পরিপার্শ্বের নকশার পরিবর্তন হয়েছে। তাঁত ও রঙ বইয়ে ত্রৈলোক্যনাথ বসু বলেন, আদিম যুগের এক প্রকার দপ্তিবিহীন গর্ত তাঁত, একটি ঝুলান ফ্রেমে শানাটিতে আটকাইয়া মাকু হাতে ছুড়িয়া এক অদ্ভুত উপায়ে এই তাঁত কাপড় বোনা হয়। এই তাঁতের মাকুকে থ্রো সালেট বলে।’

সুতার দিক দিয়ে জামদানি কাপড় তিন প্রকারের হয়ে থাকে- ফুল কটন জামদানি, হাফ সিল্ক জামদানি ও ফুল সিল্ক জামদানি। নকশার বৈচিত্র্যের কারণে জামদানি কাপড় বাংলাদেশের নারীদের কাছে অধিক জনপ্রিয়। মসলিনের মতোই জামদানি শাড়ি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত স্থান সোনারগাঁও। ঐতিহাসিকভাবে জামদানির উৎপাদন অঞ্চল মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। এছাড়া বাংলাদেশের কাপাসিয়া, রূপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে জামদানি শাড়ি উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গৃহবধূদের কাছে আজ পর্যন্ত জামদানি শাড়ি প্রিয় একটি কাপড় হিসেবে বিবেচিত হয়। জামদানি কাপড়ের ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে সব বয়সের নারীই কিনতে আগ্রহী হন। 

এইচএকে/এইচএন/এএ