লোপা কিংবা হুর নুসরাত এখন পরিচিত নাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কারণে এই নাম এখন সবার পরিচিত। পছন্দ অনুযায়ী রুচিশীল পোশাকের সমাহার ‘হুর নুসরাত’ এ। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং দেশের বাইরে তার এই পোশাকের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। ফেসবুকের মাধ্যমে এই উদ্যোক্তা তার ব্যবসা ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায় এবং মন জয় করে নিয়েছেন দেশের বাইরের ক্রেতাদেরও।

ফেসবুকে হুর নুসরাত পেজের মাধ্যমে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের পোশাকের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন। সেটি ঈদ কিংবা বিভিন্ন পার্বণ সামনে রেখে করা হয়। ছোট্ট পরিসরে শুরু করলেও আজ তার প্রতিষ্ঠানের নাম অনেকের কাছে পৌঁছে গেছে। কেনাকাটা করতে নারীদের আগে যেমন শপিং মলগুলোতে যেতে হতো, সেই ঝামেলা কমিয়ে এখন অনলাইনেই অনেকের ভরসা। আর সেই ভরসার জায়গাটাপাকাপোক্ত করে ফেলেছেন নুসরাত লোপা। অনলাইনে কেনাকাটা নিয়ে তিনি জানান, অনলাইনে একটি জিনিস পছন্দ করে সেটি কেউ অর্ডার করলে দেখা যায়, জিনিসটি যখন তার হাতে এসে পৌঁছে, তখন অনেক সময় ছবির সঙ্গে পণ্যটি মেলানো যায় না। কিছুটা তফাৎ থাকে পছন্দের ড্রেস কিংবা যেকোনো প্রয়োজনীয় বস্তুতে। কিন্তু আমার এখানে এমনটি হয়নি। আমার পোশাক হাতে পেয়ে ক্রেতারা খুশি হয়। কারণ আমি তাদের মানসম্পন্ন জিনিস দিয়ে থাকি। আর মান ধরে রাখার কারণেই ক্ষুদ্র পরিসর থেকে যাত্রা শুরু করে আমার ব্যবসা আজ এখানে এসেছে। পণ্যসামগ্রীতে সবাই যদি মান ধরে রাখেন, তাহলে আমার মনে হয়, যেকোনো ব্যবসা থেকে তাকে সরে আসতে হবে না। উদ্যোক্তারা দেখতে পাবেন সাফল্যের মুখ।

জানতে চেয়েছিলাম হুর নুসরাত শুরুর ঘটনা। কিভাবে পথচলার শুরু এই প্রতিষ্ঠানের? লোপা জানালেন, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম নিজেকে নিয়ে। আমরা চার বোন, কোনো ভাই নেই। তাই সামাজিকভাবে আমার বাবা-মাকে কিছুটা হেয় হতে হতো। তাদের অনেক সময় শুনতে হতো তারা কী করবে বৃদ্ধ বয়সে। মূলত সেখান থেকেই নিজের কিছু করার ইচ্ছা। কেন একটি মেয়ে মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারবে না? কেন একটি মেয়ে তার বাবা-মাকে দেখতে পারবে না? ছোট থেকে তাই আমি চাইতাম মেয়ে হয়েই বাবা-মাকে দেখব, তাদের পাশে থাকব। আমার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব, সে স্বপ্ন নিয়ে আমি এসএসসির পর ঢাকায় আসি। থাকতাম ফুফুর বাসায়। ঢাকায় আসার পর বুঝতে পারলাম পৃথিবীটা অন্য রকম। কিন্তু সেসব পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। আমি লালমাটিয়া মহিলা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাবার ব্যবসায়িক অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে পড়ে। তবে এ সময়গুলোয় আমার বান্ধবী সালমা মানসিকভাবে আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে, যা আসলে ভোলার নয়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ি। ডাক্তার হওয়া আর হলো না। তখন আমি লালমাটিয়া কলেজের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই।

কিছুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যায় এবং সন্তানের মা হই, কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। আমার স্বামী আমার পড়াশোনার বিষয়ে সব সময় সাহায্য করেছে। গ্র্যাজুয়েশন শেষে একটি মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়। তবে স্বামীর সম্মতি না থাকায় চাকরিটি করা ছেড়ে দিই। পরে আমি সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম, যেখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখি, কাজের প্রয়োজনেই ফেসবুক পেজ ক্রিয়েট করি। একটি কুর্তি বানিয়ে পেজে ছবি আপলোড করি। এখানে আমার ৪৮টি অর্ডার আসে, মূলত সেখান থেকেই কাজ করা শুরু। ২০১৫ সালের কথা। আমি ওই সিঙ্গেল কুর্তি দিয়েই ‘হুর নুসরাত’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খুললাম। এরপর মাঝের দুই বছর কিভাবে গেছে, আমি নিজেও জানি না। নিবিড়ভাবে লেগে ছিলাম। পরিশ্রম করেছি এবং তার ফলও পেয়েছি।

লোপা আরো জানান, স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছেটা ছোটোবেলা থেকেই ছিল। চার বোনের ভাই নেই। সেই হিসেবে মা-বাবার ছেলে না থাকায় ছেলের জন্য সুপ্ত একটা বাসনা ছিল, আর তা পূরণের একটি দায়বদ্ধতা ছিল আমার মধ্যে। প্রতিজ্ঞা ছিল, একজন ছেলে মা-বাবার প্রতি যে দায়িত্ব পালন করে, আমরা বোনরাও তা-ই করব। মা-বাবার জন্য মেয়েরা ছেলের চেয়ে কম কিছু নয়। এটি বোঝানোর তাড়না ছিল। সেই তাড়নায় আমি নিজেকে স্বাবলম্বী করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়তে কঠোর শ্রম দিতে হয়েছে আমাকে। আমি আমার পরিশ্রমের মূল্য পাচ্ছি। আমার স্বপ্ন ও স্বপ্নপূরণের পথের পার্থক্য খুব বেশি নয়। ২০১৬ সালের বৈশাখ থেকে ঈদের মধ্যে আমি মোটামুটি পরিচিতি পেয়ে যাই। তখন মনে হলো, আমি একটা কিছু করছি। বেশিরভাগ সময় আমার ব্যবসায়িক জগতের ভাবনায়ই বুঁদ হয়ে থাকতাম। কিভাবে পণ্যের মান বাড়ানো যায়, নতুন নতুন পণ্যের সংযোজন ঘটানো যায়। হয়তো আমার একটি রং পছন্দ হয়েছে, সেখান থেকে একটি সুতা কেটে রাখতাম। একটি সাদা শাড়িতে পছন্দের রঙের সুতাগুলো স্কচটেপ দিয়ে বসিয়ে তাঁতিকে বুঝিয়ে দিতাম। সেখান থেকে শাড়ি তৈরি হতো, সেই শাড়িগুলো ফেসবুকে আপলোড করতাম। এভাবে খুব সাড়া পেলাম। ব্যবসার প্রসারও বাড়তে থাকল।

লোপা শুধু নিজেই স্বাবলম্বী হননি, করেছেন অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও। তিনি বলেন, এখন মোটামুটি অর্ধশত কর্মী কাজ করছে আমার সঙ্গে। আমার পোশাকগুলো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। অর্থাৎ যেসব দেশে বাংলাদেশি আছে, সেসব দেশেই আমার পোশাকের চাহিদা আছে। শতভাগ দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করি। শাড়িগুলো একেবারে হাতে বোনা, আসে ঠাকুরগাঁও থেকে। নিজে ডিজাইন দিয়ে রং করে শাড়িগুলো আনি। শাড়ি, থ্রিপিসগুলো ন্যাচারাল ডায়িং করা, পার্টি ড্রেস ও শাড়ি রয়েছে। কেউ হয়তো শুধু শাড়ি বা থ্রিপিস নিয়ে কাজ করছেন; কিন্তু আমার এখানে প্রতিটি পণ্য আছে। পণ্যের গুণগত মানের ওপর সব সময় নজরদারি থাকে আমার। এ কারণে ক্রেতা আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন। কারণ ক্রেতার সন্তুষ্টির ওপরই নির্ভর করে আমার ব্যবসার প্রসারের সম্ভাবনা। সুতরাং এখানে কোনোরকম ছাড় দেয়া যাবে না।

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বললে লোপা বলেন, যারা নতুন কাজে আসতে চায়, তাদের উদ্দেশে বলব কাজ থামিয়ে রাখা যাবে না। আপনার নিজের কাজে ফোকাস করতে হবে, চারপাশের মানুষ কী বলছে তা নিয়ে ভাববেন না। ব্যবসায় লেগে থাকুন আর ধৈর্য রাখুন। যদি সামনে সমস্যা আসে, তবে তা মোকাবেলা করার সাহস থাকতে হবে।

এইচএন/এএ