পৃথিবীর প্রতিটি মা-ই সফল মা। কারণ সন্তানকে জন্ম দেওয়ার মতো মহৎ ও কঠিন কাজ যে করতে পারে, তার আলাদা করে সফল হওয়ার কিছু নেই। তবুও তথাকথিত সামাজিক সফলতার মাপকাঠিতে আমরা সেসব মাকে আলাদাভাবে সফল ভেবে থাকি, যারা সংসার ও সন্তান সামলেও ক্যারিয়ার গড়তে পারে। আজ আমরা তেমন কিছু মায়ের গল্পই শুনবো।

রোকেয়া বেগম। তিনি একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তার দুজন সন্তান, একজন পুত্র, আরেকজন কন্যা। তারা এখন বড় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি যেসময় চাকরি করতে শুরু করি, তখন গ্রামগঞ্জে শতকরা দুজন মেয়ে চাকরি করতো। কেউ চায়নি আমি চাকরি করি। অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। আমার সন্তানদেরও আমার কাছের মানুষরা কেউ আগলে রাখেনি। ওদের নিয়েই আমি আমার কাজ চালিয়ে গেছি। কখনো কখনো এমন হয়েছে, আমি স্কুলে ক্লাস নিচ্ছি, ওদের মাঠে খেলতে ছেড়ে দিয়েছি, ওরা মাঠে বালুর ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন অনেক ঘটনা আছে, বলে শেষ করা যাবে না।’ আজও তিনি শিক্ষকতা করছেন, সংসার করছেন। সন্তানরা বড় হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে আর কষ্ট নেই। তিনি বলেন, ‘শত প্রতিকূলতার ভেতরও যে মা নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত রেখেছেন, তাকে শ্রদ্ধা জানাই।’

সোহানা আক্তার। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অডিট অফিসার হিসাবে কর্মরত। অডিট ডিপার্টমেন্টে কাজের চাপ বেশি থাকে, আর তা যদি হয় কোনো স্বনামধন্য কোম্পানির তাহলে তো কথাই নেই। তার দেড় বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। আমরা জানি, সন্তান আর সংসার সামলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কিংবা চাকরি করা কতটা কঠিন ব্যপার। সন্তান হওয়ার পর প্রতিটি নারীরই শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক পরিবর্তন আসে। তারপরও যখন কোনো নারী শক্ত হাতে ক্যারিয়ার ধরে রাখে, তাকে বাহবা দিতেই হয়। এ দেশের বেশিরভাগ মা সন্তান ছোট থাকা অবস্থায়ও চাকরি চালিয়ে যেতে পারে, যার পেছনে মূল কারণ বা অনন্য অবদান হচ্ছে তাদের মায়ের পাশে থাকা। সোহানা আক্তারও অফিস করেন একমাত্র আদরের সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে। যদি এসব মা পাশে না থাকতো, তাহলে বেশিরভাগ মেয়েকেই সন্তান হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিতে হতো। এসব কর্মজীবী মায়েদের পাশাপাশি তাদের সাপোর্ট হয়ে থাকা মায়েরাও সমান প্রশংসার দাবিদার।

তাসনীন জাহান। সবেমাত্র পড়াশুনা শেষ করেছেন তিনি। তার সন্তান প্রাইমারি স্কুলে অধ্যয়নরত। তিনি একটি স্কুলের গ্রাফিক্স ডিজাইনের শিক্ষক। এছাড়া তার নিজস্ব এগ্রিফার্মের বিজনেস ও ট্যুরিজম রিলেটেড বিজনেসও রয়েছে। পড়াশোনা, সংসার, সন্তান, ক্যারিয়ার সবকিছু সামলাতে তাকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবুও তার মা আর একমাত্র ছোট বোন তার অনুপস্থিতিতে বাসায় সন্তানের দেখাশোনা করে। প্রয়োজনে স্কুলেও নিয়ে যায়, পড়াশোনা করায়, তাই যাত্রাপথটা কঠিন হলেও সে সফলতার সাথে সবকিছু সামলে নিচ্ছে।

ইতি চৌধুরী। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। তার তিন বছরের একমাত্র পুত্র সন্তান রয়েছে। তিনি চাকরি করতেন, সন্তান হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছাড়াও তিনি লেখালেখি করেও উপার্জন করতেন। চাকরিটা ছিল শুধুই তার উপার্জনের উৎস, কিন্তু লেখালেখিটা ছিল একইসঙ্গে উপার্জনের উৎস এবং মনের খোরাক, ভালোবাসার কাজ। তাই সন্তান হওয়ার পর আর চাকরিতে যুক্ত না হলেও লেখালেখিটা চালিয়ে গেছেন। সন্তান হওয়ার দরুণ কিছুটা বিরতি নিয়েছিলেন। ওই সময়টা সন্তানকে দেখাশোনা করতে করতেই কেটে যেত। সন্তান একটু বড় হওয়ার পরই আবার পুরোদমে লেখার জগতে, বই পড়ার জগতে ফিরে আসেন। সন্তানকে দেখাশোনার আর সংসারের কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় বেঁচে থাকে, সেটুকু সময়ই তিনি কাজে লাগান। প্রতি বছর তার এক বা একাধিক বই বইমেলায় প্রকাশিত হয় এবং তা পাঠকপ্রিয়ও হয়। তিনি বলেন, ‘পাঠকদের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। যে সময় আমি বিরতি নিয়েছিলাম, তারা আমাকে সাপোর্ট করেছে। তারা পাশে ছিল বলেই নতুন উদ্যমে ফিরে আসার সাহস পেয়েছিলাম।’

ফাতিমা রুমি। তার একমাত্র পুত্র সন্তান অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বর্তমানে তিনি একটি কলেজের ইংরেজি লেকচারার পদে চাকরি করছেন, নিজের একটি ইংরেজি একাডেমি পরিচালনা করছেন, লেখালেখি করছেন। তার এ পর্যন্ত ৭টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। তার নিজের একটা ইউটিউব রান্নার চ্যানেল আছে, সেই চ্যানেল নিয়েও কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, একাগ্রতা থাকলে সফল হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে স্বামীর সাপোর্ট থাকা খুব জরুরি হলেও তিনি কখনো তা পাননি। কিন্তু তিনি তার মা, বোন আর ভাবীদের সাপোর্ট পেয়েছিলেন। তারা যেন তার সন্তানকে দেখাশোনা করতে পারে তাই মা-বাবার বাসার কাছে নিজের বাসা নিয়েছিলেন, কর্মস্থলও সেখানে ম্যানেজ করেছেন। সেই মানুষগুলো পাশে ছিল বলে এবং তিনি খুব পরিশ্রমী বলে সন্তান আর সংসার সামলেও ক্যারিয়ারে সফল হতে পেরেছেন।

আলেয়া বেগম আলো। তার দুজন পুত্র সন্তান রয়েছে। দুজনই স্কুলে পড়ে। তিনি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থা থেকেই চাকরি করছেন। তার কর্মজীবনের বয়স এখন ২৩ বছর। সন্তান হওয়ার পর প্রথম দিকে বাসায় বসেই কাজ করতেন। তারপর একজন হেল্পিং হ্যান্ড যোগাড় করে তাদের কাছে সন্তানদের রেখে বাইরে কাজ করতে যেতেন। পরবর্তীতে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন ছিলেন, তখন তারাই তার সন্তানদের দেখাশোনা করতেন। তিনি চাকরির পাশাপাশি নিজের ব্যবসাও শুরু করে দিয়েছিলেন ততোদিনে। এখন সন্তানরা মোটামুটি বড় হয়েছে, দেখাশোনা করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কাউকে এখন আর প্রয়োজন নেই। তিনি তার পুত্র সন্তানদের সমস্ত ঘরের কাজ, রান্নাবান্না শিখিয়েছেন। তিনি মনে করেন, কাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য থাকাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুচিত। এছাড়া তার অনুপস্থিতিতে তার সন্তানদের যেন কোনো সমস্যা না হয়, তাই সব কাজ শিখিয়েছেন। তিনি এখন একটা প্রকাশনীর প্রকাশক। এছাড়া অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন বেশ কিছুদিন হলো। তার অভিনীত বিভিন্ন নাটক, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রয়েছে। তার সন্তানরাও তাকে খুব সাপোর্ট করে। তাই তার ক্যারিয়ারটা খুব সাজানো গোছানো। 

মা দিবসে পৃথিবীর সকল মায়েদের আমরা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। মায়েদের হাসিতে পৃথিবী আলোকিত হোক।