ছবি: প্রতীকী

‌‘আমি মূলত ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বিলং করি। আমি ও আমার ভাইবোন আম্মার সঙ্গেই আছি।’ দু’টি বাক্য যতবার উচ্চারণ করি ততবার ভেতরে কেমন রক্তক্ষরণ হয়, তা হয়তো বাইরে থেকে কেউ বুঝবে না। কৈশোর থেকেই আমার জীবন সমবয়সী আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো না। স্কুলের কোনো প্যারেন্টস মিটিংয়ে আমার বাবা নয়, মা-ই উপস্থিত থাকতেন। বোর্ড পরীক্ষাগুলোতে অন্যদের মতো বাবা-মার সঙ্গে নয় বরং আমার নানু-মা-আন্টির সঙ্গে আসা যাওয়া হতো। নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় কোনো কিছুর আবদার আমি বাবাকে করার সুযোগ পাইনি, মাকেই করেছি। আমার মনে পড়ে এখনো-নানুবাড়িতে থাকায় প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের নানান ধারালো মন্তব্য।

এখনো একটি ঘটনা বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে আমার। উচ্চ মাধ্যমিকের বোর্ড পরিক্ষার সময় হলে ঢোকার আগে যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন দেখেছিলাম মূল গেটের বাইরে শতশত অভিভাবকের মাঝে আমার মা ও নানু আমার দিকে হাসিমুখ করে তাকিয়ে আছে। হলে ঢুকতে ঢুকতে চেপে চেপে কান্না করছিলাম আমি। আর এই কান্না সুখের ছিল। নানা কাজে যখন আমাকে বারবার অন্যদের বোঝাতে হয়তো যে বাবা আসতে পারবে না, বাবার সঙ্গে থাকি না, এই না সেই না; তখন রাগও হতো, আর মন চাইতো বলে দিই যে- বাবা নিয়ে আর কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চাই না।

বিভিন্ন ডকুমেন্টে যখন আমার নামের পর বাবার নাম ম্যান্ডাটরি হিসেবেই লাগে তখন আমার রাগ হতো খুব। এখনো নানান কারণে আমাকে ভেঙেচুরে বলতে হয় যদি কোথাও বাবাকে হাজির করতে না পারি। বাবাকে হাজির করতে পারবো না ব্যাপারটা এমন না,  আমার কোনো প্রয়োজনে বাবাকে ডাকলে আসতে চাইবে না ব্যাপারটা তাও না, বরং আমার বাবা হিসেবে কোথাও জাহির করলে সম্মান বাড়বে বই কমবে না। কেননা আমার মা ও নানু আমাকে তেমনি করে গড়ে তুলেছেন। তবে কেন আমি তাকে হাজির করাতে চাইবো যেখানে তিনি আমার মাকেই বুঝতে পারেননি। আমার মায়ের প্রাপ্য সম্মানটুকুই দিতে পারেননি। আমার জন্মদাতা পিতা ছাড়া আর কোনো প্রয়োজনেই যেহেতু তিনি ছিলেন না, সেখানে কী দরকার তাকে হাজির করানোর।

তবে জয়িতা সম্মাননা নেওয়ার জন্য কুলিয়ারচর উপজেলা থেকে ডাকলো তখন দেখলাম আমার মায়ের নামে আমায় ডাকলো- আহা, কী যে ভালো লেগেছিলো। মন চাইছিল যে বলি, প্লিজ আবার ডাকেন আমি কথাটা রেকর্ড করে রাখি। আম্মা যখন আমাদের ছোট্ট বড় অর্জনে আনন্দিত হন, যখন আম্মা আস্থা ও বিশ্বাসের চোখে তাকান আমার দিকে তখন নিজেকে ঠিক কতটা ভাগ্যবতী মনে হয় ভাষায় বর্ণনাতীত। মাঝে মাঝে ভাবি- আমার মা না জানি কত কী ফেইস করেও এখনো এমন অটল, ধৈর্যশীল আছেন। আম্মা যখন বলে- ‘হতাশ হয়োনা কিছুতেই, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, সৎ থাকো, ভাইবোনরা একত্রে থাকো, সব দুঃখ-কষ্ট একদিন বিলীন হয়ে যাবে’। হ্যাঁ, তাই চেষ্টা করি অন্তত। 

একজন সিঙ্গেল মাকে বাস্তবিক অর্থে অনেক কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই অবস্থায় সব সহ্য করে সন্তানদের নিয়ে টিকে থাকা পৃথিবী জয় করার মতোই কঠিন। তবে আমি এও চাইনা যে কেউ কোনো এক স্নেহের অভাববোধ নিয়ে ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হোক। হাইকোর্ট যখন অনুমোদন দিলো- ‘এখন থেকে শুধু বাবা নয় মা ও আইনগতভাবে প্রধান অভিভাবক হতে পারবেন’ সত্যিই চোখের জল আটকাতে পারিনি। এই অশ্রু আনন্দের অশ্রু ছিল।

সবশেষে এটাই বলবো যে- এই স্বীকৃতি যে কত বাঁধার শেকল খুলে দিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন পদে পদে বাবার অনুপস্থিতি এখন আমার মতো মিশুদের কম ভোগাবে নিশ্চয়ই! স্বস্তি দেবে কিছুটা হলেও। শুধু সব জায়গায় বাস্তবায়িত যেন হয়, এটুকুনই চাওয়া। প্রয়োজনে আম্মার থেকে দূরে থাকলেও আম্মার মুখটা মনে হলেই ভাবি-  আল্লাহ আমায় শক্তি দিন যেন একদিন আমাদের সাফল্যে আম্মাকে চমকে দিয়ে আম্মার সব দুঃখ ভুলিয়ে দিতে পারি! আমার আম্মা, আমার শক্তি! হ্যাঁ, নানান প্রতিকূলতায় আম্মার মুখ-ই আমার শক্তি, সাহস!