ছবি: প্রতীকী

সংসার জীবনের শুরুর দিকে চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন আব্বা। আম্মা থাকতেন আমাদের গ্রামের বাড়ি, টর্কিতে। হঠাৎ শখ করে আম্মাকে কিছু গহনা উপহার দিতে চাইলেন আব্বা। সোনার দাম শুনে আম্মা বললেন, গহনা না দিয়ে এই টাকায় তুমি বরং আমাকে ঢাকা শহরে একটুখানি জমি কিনে দাও, তাহলেই আমি খুশি। আব্বু তাই করলেন। ১৯৭৭/৭৮ সালে আম্মার জন্য কেনা সেই এক টুকরো জমিতে আমাদের সব ভাই-বোনের জন্ম, শৈশব, বেড়ে ওঠা।

সব পরিবারেই কিছু আলাদা আলাদা নিয়ম থাকে। আমাদের পরিবারের নিয়ম ছিলো, আব্বা সব সময় আমাদের স্নেহ ভালোবাসা দেখাতেন, আম্মা শাসন করতেন। অফিস থেকে আব্বা বাড়ি ফিরলেই আমাদের প্রাণে জোর বেড়ে যেত। আম্মার হাতে শাসনের অস্ত্রগুলো তখন অসহায় হয়ে পড়ত। 

আমাদের ছোটবেলার জীবনে মসজিদের মাইকে মাগরিবের আজান শোনা মানেই ছিল খেলার মাঠ থেকে দৌঁড়ে বাড়িতে যাওয়ার ঘণ্টা বেজে ওঠা। বাড়ি ফিরে ঝটপট পড়ার টেবিলে বসে গলা ফাটিয়ে পড়তে থাকা, হঠাৎ কখনো পড়ার শব্দ বন্ধ হলেই শুনা যেতো আম্মার হুংকার।

আম্মা আমাদের কাদামাটির মতো নিজ হাতে যত্ন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তবে চার-ভাইবোনের আমরা কেউ পুরোপুরি আম্মার মনমতো হইনি। এরপরও আম্মা আমাদেরকে নিয়ে গর্ব করেন। ছোটবেলায় মনে হতো আম্মা অনেক বেশি কড়া মেজাজের, খিটখিটে, আমার ইচ্ছা-খুশি সব কিছুতেই খবরদারি করেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় যখন আমি নিজে এসে দাঁড়িয়েছি আম্মার জায়গায়, এখন পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পারি একজন মায়ের অবস্থানকে। 

সন্তানকে লালন-পালন করতে গিয়ে আম্মা মমতার চেয়ে কঠিন চেহারা দেখেছি বেশি। কৈশোর-তারুণ্যে আম্মার সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সময় একটা দূরত্ব অনুভূব করতাম। যদিও এখন সেই দূরত্ব আর নেই। এখন আছে শুধু আমাদের সেই মধুর স্মৃতিগুলো। আম্মাকে কখনো বলা হয়নি, ‘আম্মা তোমাকে আমি ভালোবাসি। নিজের একার সংসারে আমি তোমাকে খুব মিস করি।’ 

আমার টিনেজ মেয়েটা যখন আচমকা বুক কাঁপিয়ে বেয়াদবি করে বসে, তখন মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। আমার ছোট্ট মেয়েটার যখন খুব জ্বর হয়, অথবা খেলতে গিয়ে মাংকি-বার থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে আসে, ওর পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে আমার তোমার কথা মনে পড়ে। 

সময় এখন আমাকে তোমার কাছাকাছি নিয়ে গেছে। এখন আমি বুঝতে পারি অফিসের কলিগদের সঙ্গে কর্ম দক্ষতায় সেরা হয়ে প্রমোশন জিতে নেয়ার চেয়েও বেশি কঠিন নিজের সন্তানের মন জেতা। তুমি জিতেছো তোমার চার সন্তানের মন।

মা দিবসের শুভেচ্ছা তোমাকে আম্মা। আমার আম্মার নাম, নুরুন্নাহার শেফালী। নিজের মেয়ে দু’টিকে কতবার করে আই লাভ ইউ বলি, কিন্তু আমার আম্মাকে একদিনও বলা হয়নি, আম্মা, আই লাভ ইউ!