গত বছর বিশ্বের ১০৪তম দেশ হিসাবে করোনাভাইরাস মহামারি শিকার হয়েছিলো বাংলাদেশ যার দ্বিতীয় ওয়েভের রেশ এখনো বয়ে চলেছি আমরা। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর মিলেছিল আমাদের দেশে। সেই থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে প্রায় নয় হাজারজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে আমরা চিরতরে হারিয়েছি। অর্থাৎ মৃত্যুহার প্রায় ১.৫%। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্তকরণের পর থেকে পরবর্তী দুইমাস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা তিন অংকের মধ্যে থাকলেও তা বাড়তে বাড়তে গত বছরের জুলাইতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। গত বছর ২ জুলাই সর্বোচ্চ ৪০১৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। আশঙ্কার কথা এই যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা গত বছরের জুলাই মাসের পর থেকে কমে এলেও এই বছরের মার্চ মাস থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। দীর্ঘ নয় মাস পরে শনাক্তের ৩৮০তম দিনে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে গতকালই।

সচেতনতাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এজন্য সবাইকে সবসময় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ভালো করে সাবান-পানি অথবা এলকোহল বেসড হ্যান্ডরাব অর্থাৎ ৭০% ইথানল বা আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল বিশিষ্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ড্রপলেট ইনফেকশন অর্থাৎ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। তাই হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ ঘষা থেকেও বিরত থাকতে হবে। করোনাভাইরাস কেবলমাত্র নাক, মুখ ও চোখের উন্মুক্ত শ্লেষ্মা ঝিল্লি দিয়েই দেহে প্রবেশ করতে পারে। যথাযথ ব্যবস্থা ছাড়া সন্দেহজনক আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকেও বিরত থাকতে হবে। অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকিকাল পার হওয়া পর্যন্ত সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। পাশাপশি বর্তমানের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ থেকে এড়াতে চাইলে আরো কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যেমন-

১. সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মানতে হবে। করোনাভাইরাস কোনো লক্ষণ-উপসর্গ ছাড়াই দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যেকোনো ব্যক্তির দেহে তার অজান্তেই বিদ্যমান থাকতে পারে। করোনাভাইরাস বহনকারী ব্যক্তি যদি কোনো কারণে হাঁচি বা কাশি দেন, তাহলে তার আশপাশের বাতাসে ৩ থেকে ৬ ফুট দূরত্বের মধ্যে করোনাভাইরাসবাহী জলীয় কণা (ড্রপলেট) বাতাসে ভাসতে শুরু করে এবং ওই পরিধির মধ্যে থাকা যেকোনো ব্যক্তির দেহে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি প্রবেশ করতে পারে। এজন্য অপ্রয়োজনীয় কোনো জনসমাবেশ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। অযথাই ভিড়ের সংস্পর্শে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।

২. গণপরিবহনে যেতে হলে বা বাইরে মানুষের ভিড়ে যেতে হলে অবশ্যই যথাযথ উপায়ে মাস্ক পরিধান করুন। আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিচর্যাকারীর মুখে এন৯৫ জাতীয় বিশেষ মাস্ক পরতে হবে।

৩. বিনা প্রয়োজনে বা কারণ ছাড়া দেশে-বিদেশে যাবেন না। কোনো ভ্রমণ-পরিকল্পনা করে থাকলে কিছুদিনের জন্য তা বাতিল করুন।

৪. অনিবার্য কারণে দেশের কোথাও কিংবা বিদেশ ভ্রমণের প্রয়োজন পড়লে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করুন।

৫. বাইরে থেকে ঘরে ফেরার পর, হ্যান্ডশেকের পর বা হাঁচি-কাশি দেওয়ার পর ভালো করে সাবান দিয়ে অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে ফেলবেন। যেসব বস্তুতে অনেক মানুষের স্পর্শ লাগে, যেমন সিঁড়ির রেলিং, দরজার নব, পানির কল, কম্পিউটারের মাউস, কিবোর্ড বা মোবাইল ফোন, গাড়ির বা রিকশার হাতল ইত্যাদি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে এসব বস্তু নিয়মিতভাবে কিছু সময় পরপর জীবাণু নিরোধক স্প্রে বা দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

৬. যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলার অভ্যাস ত্যাগ করুন।

৭. হাঁচি কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই রুমাল কিংবা টিস্যু পেপার ব্যবহার করুন। ব্যবহৃত টিস্যু বা রুমাল যেখানে সেখানে না রেখে যথাযথ জায়গায় ফেলতে হবে।

৮. নাক-মুখ না ঢেকে কারো সামনে মুখের উপর যেয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা অবলম্বন করলে এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

৯. বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা যাদের পূর্ব থেকেই ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি জটিলতা প্রভৃতি সমস্যা বিদ্যমান তাদের প্রতি অতিরিক্ত যত্ন নিতে হবে ও সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।

১০. নিজের বা পরিচিত কারো করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা জরুরি ফোনে যোগাযোগ করতে হবে, যেন দ্রুত করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় এবং প্রয়োজনে সঙ্গনিরোধ তথা কোয়ারেন্টাইন পালন করা যায়।

শুরুর দিকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো টিকা বা কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি ছিলো না। শুধু সাপোর্টিভ কিছু চিকিৎসার মাধ্যমে এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিদের শুশ্রূষা করা হচ্ছিলো। তবে পরবর্তীতে ট্রায়ালের ভিত্তিতে রেমডিসিভির, ফ্যাপিরাভির, টকিলিজুমাব ইত্যাদি ওষুধের প্রয়োগ শুরু হয় করোনার চিকিৎসায়। মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পৃথিবীর অনেক দেশেই কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা প্রদান করা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকার মাধ্যমে গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে এ ধরণের ভ্যাক্সিন কার্যক্রমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সেইসাথে করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত সন্দেহ হলে নিয়মিত পানি/স্যালাইন পান করে হাইড্রেশন ঠিক রাখতে হবে এবং এর সাথে জিংক, আয়রন এবং ভিটামিন-এ, ডি ও সি সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে। কারণ এগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে কার্যকর করে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করতে পারবে।

এইচএন/এএ