ছবি : সংগৃহীত

‘পাঠক নেই তবু আলো জ্বেলে বসে থাকতাম। মশার সে কী পুনপুনানি। একলা পেয়ে চামচিকার সে যে কী ছোটাছুটি, তাদের রাজ্য দখল করেছি বলে। এর ওপরে আবার গৃহিণীদের কানে উঠে গেল আমাদের এই কাণ্ড। একলা মৎস্য শিকারি বকের মতো বসে থাকা।’ ‘ঢাকার গণপাঠাগার, আলোয় ভরা ভুবন’ বইয়ের কয়েকটি বাস্তব লাইন।

এই বইয়ে বর্ণিত হয়েছে রাজধানী ঢাকার ৪০টি বেসরকারি গণপাঠাগার প্রতিষ্ঠার নানা অজানা অধ্যায়। বিবৃত হয়েছে পাঠাগারগুলোর টিকে থাকার লড়াইয়ের অন্তহীন প্রচেষ্টার কথা। দেশের প্রবীণ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথায়, এ যেন আত্মসমর্পণে নীরব অসম্মতি।

বইটিতে আরও আছে এই গবেষণাকাজ নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা, বাংলাদেশে পাঠাগার চর্চার বিকাশ, ঢাকায় পাঠাগার চর্চা ও বেসরকারি পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্বে থাকা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ।

আরও পড়ুন : বাংলাদেশের সাহিত্য : পঞ্চাশ পেরিয়ে 

বলা হয়, প্রতি বর্গকিলোমিটারের মধ্যে একটি গণপাঠাগার থাকা আবশ্যক। সেই হিসেবে কম করে হলেও এই দেশে ৫০ হাজার পাঠাগার থাকার কথা। কিন্তু জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের হিসাবে দেশে বেসরকারি গণপাঠাগারের সংখ্যা ১৬শর মতো। যদিও এর মধ্যে অস্তিত্বহীন পাঠাগারের সংখ্যা কম নয়। আর সারা দেশে সরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যাও একশর বেশি নয়।

পাঠাগার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। সমাজের চারদিকে এত অশান্তি-বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারে সুস্থ জ্ঞানচর্চার বিকাশ। পাঠাগার হবে এমন, যেখানে মানুষ অবাধে চলাচল করতে পারবে। চেয়ার পেতে কিংবা মেঝেতে বসে স্বাধীনভাবে বই পড়তে পারবে। পথে-ঘাটে আর চায়ের দোকানের আড্ডায় না জমে বই নিয়ে আড্ডা দিবে। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে গোধূলিতে সেখানে এসে বসবে গুরুজনেরা। জমবে আড্ডা, বিষয় হবে বই!

সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি পাঠাগার কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী উদ্যোগেরও ঘাটতি রয়েছে।

আরও পড়ুন : গ্রন্থ সংস্কৃতি  

পাঠাগারগুলোয় পর্যাপ্ত পরিমাণ বই থাকলেও এর অধিকাংশ বই পাঠক ছুঁয়ে দেখে না। এজন্য প্রয়োজন পাঠকের চাহিদা গুরুত্ব দেওয়া। জনপ্রিয় লেখকদের পাশাপাশি নবীন লেখকদের বইও প্রাধান্য দেওয়া।

বর্তমান প্রজন্ম যতটা না বইয়ের দিকে ঝুঁকছে তার চেয়ে শতগুণ বেশি ঝুঁকছে স্মার্ট ফোনের প্রতি। প্রিয়জনের জন্য বই কিনতে পারে ঠিকই কিন্তু সেই বই পড়ে দেখার সময় তাদের হয় না।

পাঠাগার থেকে দুই একটা বই পড়ার পর অনেকের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। ফলে পাঠাগারের দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। জোর করে তো বই পড়ানো যায় না। কিন্তু কিছু কৌশল অবলম্বন করলে অহেতুক জোর করা লাগে না।

একটি পাঠাগার শুধু বই পড়ার জন্যেই হবে কেন? সপ্তাহে/মাসে এক-দুটি আলোচনা-পাঠচক্র হবে, আড্ডা হবে। মাসিক বুক রিভিউ হবে, স্বল্প ব্যয়ে ম্যাগাজিন হবে। সেরা পাঠক পুরস্কার থাকবে। পাঠক বাড়বে কমবে না।

রাস্তার মোড়ে, দোকানের সামনে জটলা পাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা না দিয়ে পাঠাগারে এসে আড্ডা দিতে সমস্যা কোথায়? এর-ওর অহেতুক কথাবার্তায় না জড়িয়ে বই নিয়ে আলোচনা করলে অসুবিধে কোথায়?

আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন 

পনেরো জন সদস্য নিয়ে শুরু হওয়া বর্তমান প্রায় পঁচিশ লাখ সদস্যের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর কথাই ধরুন। দেশের প্রায় প্রতিটি স্কুল কলেজেই এর সদস্য রয়েছে। তারা তো বইকে পাঠকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়।

তারপরও আঠারো কোটির মানুষের দেশে এর পাঠক সংখ্যা কেন এত কম? এর কারণ আমরা বই পড়ি ঠিকই কিন্তু জানার জন্য না। পরীক্ষায় পাস আর সার্টিফিকেট অর্জনের জন্যই আমরা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাই, অন্যথায় তা ছুঁয়েও দেখি না। এই ধারা থেকে যতদিন বের হতে পারব না, ততদিন মরিচাধরা পাঠাগারের দরজা আর খুলবে না।

আজকাল তো আরেকটি বড় প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। কাউকে বই পড়তে বললেই প্রথমেই বলে বসে—'বই কেন পড়তে হবে?' এর অকাট্য যুক্তি দিয়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেছেন, 'মানুষ জন্মেছে প্রাণী হয়ে। সেটা এক ধরনের মানুষ। আরেক ধরনের মানুষ হচ্ছে বিকশিত মানুষ। এই বিকাশের জন্য শুধু বই পড়লেই হবে। কারণ যে বই পড়ে, সে কবিতাও পড়ে, গান শোনে, চিত্রকলা বোঝে; পূর্ণিমার আলো, নীল আকাশ সবই বোঝে।' প্রকৃতপক্ষে যে বই পড়ে, সে জীবনকে বোঝে। যা অন্যেরা পারে না।

আরও পড়ুন : নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য 

বাংলাদেশ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই দেশের অন্যতম মূল সমস্যা হলো জনসংখ্যার আধিক্য। শিক্ষিত না হলে বিপুল জনসংখ্যা দেশের জন্য সম্পদ না হয়ে বোঝা হিসেবে পরিণত হয়।

এই বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করাই হচ্ছে আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষার প্রসার ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি গ্রন্থাগারের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

‘ঢাকার গণপাঠাগার, আলোয় ভরা ভুবন’ বইটিতে রয়েছে ঢাকার পাঠাগারগুলোর এবং পাঠকের অভাবে তার বিলুপ্ত হওয়ার কাহিনি। অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে ভরপুর একটি বই। এর লেখক কাজী আলিম-উজ-জামান। বইটি প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী। বইয়ের মুদ্রিত মূল্য ৬০০ টাকা।

শরীফুল ইসলাম ।। সৈকত সরকারি কলেজ, চরবাটা, সুবর্ণচর, নোয়াখালী