ছবি : সংগৃহীত

আনা ভালোবাসায় অনুরণিত, প্রেমাকাঙ্ক্ষায় নিমগ্ন রমণীরত্ন আর তার স্বামী কারেনিনা শৃঙ্খলায় বন্দি, ভাবলেশহীন, স্বধর্মপরায়ণ, নৈষ্ঠিক, অভিজাত সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একজন। এই দুই বিপরীত মানুষের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সামাজিক সুখ-সংসার করে যাওয়ার নাটকের ছন্দে পতন ঘটায় ভ্রনস্কি।

দেয়ালের ফাটল থেকে চুইয়ে আসা আলোর মতো ভালোবাসা হয়ে আনার মনের সুপ্ত ভালোবাসাকে উদ্বেলিত করে তোলে ভ্রনস্কি। ‘কিন্তু এমন একটা সময় এলো যখন আর নিজেকে ঠকানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো না : তখনো তো আমি একটা জীবন্ত মানুষই ছিলাম, আর ঈশ্বর যদি আমাকে এমন একটি নারী হিসেবে গড়ে থাকেন যে ভালোবাসতে চায়, বাঁচতে চায় তাহলে সেই দোষ তো আমার নয়।’ এই আকুতি ভালোবাসায় বাঁচতে চাওয়া আনার।

সামাজিক শৃঙ্খলায় বন্দি সফল স্বামীর যোগ্য সঙ্গিনী আনাকে নিজের আয়নায় খুঁজে পাওয়ার পথ তৈরি করে দেয় ভ্রনস্কি। লঘু আনন্দে গা ভাসিয়ে চলা ভ্রনস্কি ভালোবাসায় আনাকেই কেবল ভেঙে চুরমার করেনি বরং নিজেও আনার তীব্রতর, গভীর, শুদ্ধ ভালবাসায় ভিন্নতর মানুষ হয়ে উঠেছে। আনা ভ্রনস্কির কাছে শখ মাত্র ছিল না বরং ছিল তার জীবনেরও অধিক।

আরও পড়ুন : নতুন আলোয় জেগে উঠুক শিশুসাহিত্য

হঠাৎ দেখা হওয়া আনা-ভ্রনস্কি যখন ভালবাসায় মশগুল এবং নতুন জীবন শুরু করতে প্রত্যয়ী তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক নিয়ম কানুন। আনা শুদ্ধ, তাই অন্য সবার মতো ভালোবাসার এই সম্পর্ককে আড়াল করে টিকিয়ে না রেখে নিজেই স্বামীর কাছে ঘোষণা করে। কারেনিনা-আনা-ভ্রনস্কি তিনজনই তাদের এই ভাঙাগড়ার সম্পর্ক মেনে নিয়ে নতুন ভুবন তৈরি করায় সম্মত থাকলেও সম্মতি মেলেনি সমাজের।

সমাজ যে তাদের কতটা বিপক্ষে তার দেখা মেলে ভ্রনস্কির ভাবনায়, যেখানে সে বলছে, ‘সুখ কাকে বলে সেই বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই; তারা বুঝতে পারে না যে ভালোবাসা ছাড়া আমাদের কাছে সুখ-দুঃখ বলেই কিছুই থাকতে পারে না; এমনকি জীবনের অস্তিত্বও না।’

তীব্রতর সেই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে, নিজেদের মতো করে বাঁচতে চেনা গণ্ডি ছেড়ে কখনো ইউরোপ, কখনো মস্কো, কখনো পিতাসবুর্গ কখনো বা গ্রামে গিয়ে নিজেদের জগৎ তৈরির চেষ্টা করে তারা। তবে সমাজের তৈরি নিয়ম ভাঙার শাস্তি থেকে নিস্তার পায়নি আনা।

পুরুষ বলে ভ্রনস্কির সামাজিক গ্রহণযোগ্যতায় ভাটা না পড়লেও আনা সমাজ থেকে পতিত হয়। আনা বলেছে, ‘তুমি বুঝতে পারছ না। আমার মনে হচ্ছে একটা অতলস্পর্শ গহ্বরের মধ্যে আমি আপাদমস্তক ডুবে যাচ্ছি, আর নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা আমি করব না। নিজেকে বাঁচাতে আমি পারবো না।’

আনা পারেনি। ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয় আনার ভালোবাসা, বেঁচে থাকার আশা এবং অমূল্য জীবনটাই। আত্মহত্যা করে আনা।

আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন

১২০ বছর আগে লিও তলস্তয় তার অমর সৃষ্টি ‘আনা কারেনিনা’-তে যে গল্পটা বলেছেন তা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা থেকে এখনো কি দূর হয়েছে? প্রতিষ্ঠিত অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি আনা। সে স্নিগ্ধ, সে বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত, ব্যক্তিত্বের আঁধার, সৌন্দর্য্যমণ্ডিত, উপভোগ্য, প্রেয়সী, সম্পূর্ণা। এত আয়োজনও কম পড়ে যায়। আনাকে আত্মহত্যারই পথ বেছে নিতে হয়।

সামাজিক চাপে অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকা আনার ভাবনা চিন্তা, নিজের সাথে নিজের যুদ্ধকে তলস্তয় বর্ণনা করেছেন নানান দৃশ্যে।  সেই অসাধারণ বর্ণনার ছলে আনার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় প্রতিটি আত্মহত্যা আসলে সমাজের পদ্ধতিগত ব্যর্থতার ফলাফল, প্রকারান্তরে হত্যা।

তলস্তয় যখন বইটি লিখেছিলেন তখন ভেবেছিলেন ২০ বছর পরে কেউ বইটি পড়লেই তিনি সার্থক। তার এই মহাকাব্যিক সৃষ্টিতে সম্পর্কের টানা পোড়েন, সামাজিক মানসিক বিশ্লেষণ এত অসাধারণ করে তুলে ধরেছেন যে ১২০ বছর পরেও তা বাস্তব।

তৎকালীন রাশিয়ার অভিজাত সমাজের পটভূমি থেকে সরিয়ে এনে পাঠকের চারপাশের সমাজেও এই উপলব্ধিগুলো আজও চমৎকার খাপ খেয়ে যায়।

আনা-ভ্রনস্কি-কারেনিনা ছাড়া পুরো উপন্যাস জুড়ে অসংখ্য শক্তিশালী চরিত্রের দেখা মেলে। প্রকৃতির কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পিত হওয়া লেভিন, তার সাদাসিধে ঘরকন্যায় অভ্যস্ত স্ত্রী কিটি, জীবনকে উপভোগ করার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত অবলনস্কি, তার স্ত্রী মাতৃত্বের প্রতিমূর্তি ডলি, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে বিপর্যস্ত শিশু সের্গেই, জ্ঞানচর্চা আর মননের প্রতীক নিকোলাইসহ প্রত্যেকটি চরিত্রই তাদের কর্মকাণ্ডে পাঠককে আন্দোলিত করেছে, ভাবনার খোরাক রেখে গেছে।

আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য 

এইসব চরিত্রদের জীবনের গল্পের ছলে তলস্তয় তখনকার রাশিয়ার রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতির নিখুঁত চিত্র উপস্থাপন করেছেন অনবদ্যতায়।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত মণীন্দ্র দত্তের ঝরঝরে অনুবাদ পড়ার গতি সঞ্চালন করে নিঃসন্দেহে। শব্দ-বাক্যর চমৎকার গঠন ভিনদেশি নামের চরিত্রগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে কোনো বাধা তৈরি করেনি।  

ডলি-অবলনস্কির ভাঙতে থাকা সম্পর্ক জোড়া দিতে এসে নিজের সম্পর্ককে ভাঙনের সূত্রপাত ঘটায় আনা। কিটি-লেভিনের তুমুল প্রেম যখন পরিণয়ে গড়াচ্ছে একই সমান্তরালে মেলে আনা-কারেনিনের সংসারের ভাঙনের চিত্র।

নিকোলাইয়ের মৃত্যুশয্যার বর্ণনায় যখন অবধারিত চরম সত্যর সামনে পাঠককে দাঁড় করাচ্ছে ঠিক তখনই কিটির গর্ভবতী হওয়ার সংবাদে নতুন আশাও দেখিয়েছেন লেখক। একই সমান্তরালে এমন বহু বিপরীত চিত্র তুলে ধরার মুনশিয়ানা খুব কম লেখাতেই মেলে।

যে পাঠক উপন্যাসটি পড়েছেন কেবল তারাই নয় যুগে যুগে এই অসাধারণ সৃষ্টির অসংখ্য উক্তি মানুষের মনের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। পুরো উপন্যাস জুড়ে ‘সব সুখী পরিবারই এক রকমের, কিন্তু প্রতিটি অসুখী পরিবার ভিন্ন ভিন্ন রকমের অসুখী’ অথবা ‘সব মানুষের জন্যই অপেক্ষা করে আছে শুধু যন্ত্রণা, মৃত্যু আর চিরন্তন বিস্মৃতি।’ অথবা ‘আমার প্রাপ্যের মাপে নয়, তোমার করুণার মাপে আমাকে ক্ষমা কর।’ এর মতো মনে গেঁথে যাওয়া লাইনের দেখা মেলে।

সব মিলিয়ে সৃষ্টির ১২০ বছর পরে এসেও ‘আনা কারেনিনা’ পাঠে কেবল আনন্দ নয়, কেবল বেদনা নয়, কেবল রোমাঞ্চিত হওয়া নয়, মেলে দর্শন, মেলে জীবনবোধ, মেলে প্রকৃতির বন্দনা, মেলে চিন্তার খোরাক, হয়ে উঠে এখনকার জীবনের সঙ্গেও একই মাত্রার প্রাসঙ্গিক।

‘আনা কারেনিনা’ বইয়ের মূল লেখক লিও তলস্তয়, অনুবাদ করেছেন মণীন্দ্র দত্ত, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মুদ্রিত মূল্য ৫৫০ টাকা।