বই আমাদের নিত্যসঙ্গী। শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি সুশিক্ষিত হতে নন একাডেমিক বইয়ের বিকল্প নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগেও এখনও অনেক বইপড়ুয়া আছে সারা দেশজুড়ে। কিন্তু এমন অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে, যেখানে এসব বই পৌঁছায়ই না। এমনকি বেশিরভাগ গ্রামেই এসব বই পড়ার এবং সহজে হাতে পাওয়ার মতো সু-ব্যবস্থা নেই। তাই তরুণ সমাজ নিজ উদ্যেগে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাগার তৈরি করছে। এতে করে সেসব এলাকার মানুষ সহজেই বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আজ এমনই একটি পাঠাগারের গল্প জানবো আমরা।

রাঙ্গুনিয়া পাঠাগার, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে তরুণদের উদ্যেগে এ পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে। শিশির মোর্শেদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ পাঠাগার গড়ার চিন্তাটা এসেছিল ২০১৯ সালের প্রথম দিকে। বইমেলা এলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বইপ্রেমীদের আওয়াজ শোনা যায়। তবে সে ধরনের আওয়াজ রাঙ্গুনিয়ায় তুলনামূলকভাবে খুবই কম পাওয়া যায়, বই নিয়ে সেখানে কথা হয় কম। তাই তিনি চিন্তা করেছিলেন, বিষয়টা নিয়ে কী করা যায়। তারপরই তিনি ভাবলেন, একটি পাঠাগার হলে বেশ ভালো হয়। মানুষ বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং দেশের অন্যসব বইপ্রেমীদের মতো রাঙ্গুনিয়া থেকেও বইপ্রেমী তৈরি হবে।

সেই চিন্তা থেকে ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ ‘পাঠশালা রাঙ্গুনিয়া (বই পড়ুয়া)’ নামে একটা গ্রুপ খোলা হয়। তার সংগ্রহে থাকা ২০০ বই নিয়ে শুরু হয় অনলাইনে ফ্রি বই আদান-প্রদান প্রক্রিয়া। পর্যাপ্ত সাড়া পাওয়ার পর তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পান। এরপর রাঙ্গুনিয়া এবং চট্টগ্রাম শহরের অনেক জায়গায় তিনি নিজ দায়িত্বে পাঠকদের কাছে বই পৌঁছে দিয়েছিলেন। পাঠকরা বই পড়ে ফেরত দিতেন এবং পুনরায় পড়ার জন্য বই নিতেন। এক সময় ফেরত দেওয়ার বিষয়টি একটু জটিল হয়ে পড়েছিল। কেননা, মানুষ যে আগ্রহে নেয়, সেই আগ্রহে ফেরত দেয় না। এটি একপ্রকার ভোগান্তির বিষয়।

তখন শিশির মোর্শেদের কাজে সহায়তা করার জন্য কয়েকজন প্রতিনিধি এগিয়ে আসেন। তাদের মতামত নিয়ে রাঙ্গুনিয়ায় গড়ে তোলা হয় এই পাঠাগার। তখন অনলাইন থেকে তাদের কার্যক্রম অফলাইনেও শুরু হয়। শুরুতে আর্থিক বিষয়টি বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। দোকান ভাড়া, দোকানের এডভান্স- সব মিলিয়ে খানিকটা ঝামেলায় পড়ে যেতে হয়েছিল। মনোবলও ভেঙে গিয়েছিল আর্থিক বাঁধার সম্মুখীন হয়ে। তারা ভেবেছিলেন পাঠাগার গড়া আর সম্ভব হবে না। কিন্তু তারুণ্যের স্বপ্নের জোরে এবং প্রতিনিধিদের সহায়তায় পরবর্তীতে তারা ঠিক পেরেছিলেন পাঠাগারকে দাঁড় করাতে।

আর্থিক প্রতিবন্ধকতা সবসময়ই ছিল, এখনো আছে। তবুও তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে কাটিয়ে ওঠার। তাদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩০০ এর বেশি এবং বইয়ের সংখ্যা ১০০০ এর বেশি। রাঙ্গুনিয়াতে প্রথমবারের মতো বইমেলা হয় ২০২১ সালে, এই পাঠাগারের উদ্যোগে। প্রতিটি বইয়ের শুভেচ্ছা মূল্য ছিল মাত্র ২০ টাকা। এতে তারা দারুণ সাড়া পান। সব বই শেষ হয়ে গিয়েছিল অল্প সময়েই।

বিশ্বের যেসব দেশে গনজাগরণ হয়েছে, প্রায় দেশেই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান, স্লোগান, পত্রিকা ইত্যাদি অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। তারাও ভাবেন- একসময় তাদের পাঠাগারকে কেন্দ্র করে শুধু রাঙ্গুনিয়া নয় সারা বাংলাদেশে একটা গণজাগরণ হবে। মানুষ পাবে বসবাসযোগ্য পরিবেশ, প্রচুর বই পড়ুয়া তৈরি হবে, দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যাবে সমস্ত বই।

রাঙ্গুনিয়া পাঠাগারে প্রায় সব বয়সী পাঠকেরা আসেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ পাঠকের বয়স ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে। রাঙ্গুনিয়া পাঠাগারে বইয়ের সংকট এখনো আছে। অনেক প্রকাশনী তাদের বই দিয়ে সহায়তা করেছেন, আবার অনেক ব্যক্তি দিয়েছেন আর্থিক অনুদান। রাঙ্গুনিয়া পাঠাগারের প্রথম টার্গেট ১০ হাজার বই, যে লক্ষ্যে পৌঁছতে আরও কিছুটা সময় দরকার। তবে তারা নিশ্চয়ই পারবে, এই দৃঢ়তাও তাদের রয়েছে।

রাঙ্গুনিয়া পাঠাগার সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা- রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে পাঠাগার গড়ে তোলা। তাদের স্বপ্ন হলো রাঙ্গুনিয়ার প্রত্যেক ঘরে একদিন বইয়ের কথা বলবে মানুষ, নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠবে সৃষ্টিশীল পরিবেশে। সামাজিক নানান পাপাচার থেকে নিজেকে দূরে রেখে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠন করবে নতুন প্রজন্ম, সেরকম একটা সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখতে চান তারা।

দেশের সর্বত্র এভাবেই পাঠাগার তৈরি হোক। একটা বইপড়ুয়া জাতি তৈরি হোক। সুন্দর এবং সুস্থ সমাজ বিনির্মানে বইপড়ুয়া জাতির কোনো বিকল্প নেই।