বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বেশ। বৃষ্টির দিন বলে অফিসে বাইরের লোকের আনাগোনা নেই। রেজা রায়হান নিজের রুমে বসে আছেন। বেশ বড়সড় রুম। তিনি কাস্টমসের মধ্যম সারির কর্মকর্তা। তার কাছে একজন দর্শনার্থী আসার কথা। বিকেল চারটায়। মনে মনে তিনি অপেক্ষা করছেন সময় ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক হওয়ার পর থেকে। যার মাধ্যমে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে সে ইংরেজি খবর পড়েন। গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা করেন। কাস্টমসের সাথে অটোমোবাইল ব্যবসায়ীদের পেশাগত দরকার থাকে। সেভাবে ঘনিষ্ঠতা রেজার সাথে। গাড়ির ব্যবসায়ী তরুণই রেজাকে অনুরোধ করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিয়ে বলেছেন, আপনি কোন চ্যানেলে বলে দিলেই হয়ে যাবে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রভাব সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানেই সাংঘাতিকভাবে থাকে। সেই সূত্র ধরে রেজার কাছে আবদার করা হয়েছে তিনি আগন্তুকের জন্য কোনো একটি টিভিতে সুপারিশ করবেন তাকে প্রোগ্রামে কাজ করার সুযোগ দিতে।

লোকের ভিড় ছিল না। বৃষ্টিস্নাত বিকেল। সাড়ে চারটার একটু আগে পরে তেহরিন হোসেন ঢুকলেন রেজা রায়হানের রুমে। গাড়ি থেকে নেমে লিফটের কত তলা ও রুমটি খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে মোবাইলে জেনে নিয়েছিলেন। তেহরিন জানালেন, ভাইয়া বৃষ্টিতে জ্যামে আটকে থাকায় বেশি দেরি হয়ে গেছে অনেক। রেজা মনে মনে ভাবলেন, বৃষ্টি হওয়ায় ভালোই হয়েছে, অফিসে অন্যদিনের মতো বাড়তি লোকজনের উপস্থিতি নেই। মুখে বললেন, নো ইস্যুজ। মনে মনে খুশিই হলেন ভাইয়া বলে ডাকায়। তেহরিন আসার পরই ল'রিয়ালের প্রসাধনীর গন্ধে পরিবেশটাই বদলে গেছে। তিনি মিরপুরের বেনারসি পরেছেন, কালো রঙের। পরে রেজা জেনেছিলেন এটা ছিল তার কৌশল, যেন হামলে পড়লে তেহরিন বাধাহীন হবেন না, তা ঢাকা পড়ে হাবেভাবে। বরং একটা সমীহের ভাব জাগে। শাড়িটি পাকা হাতে পরানো, প্রচুর পিনিং করে। চুল সিংহের কেশরের মতো বিন্যস্ত, রেডিস রঙ করা। আলগা চোখের পাপড়ি লাগানো, মণিতে নীলাভ লেন্স পড়ে আছেন। মুখে মেকআপের জেল্লার কথাটা বলতেই হয়। সূক্ষ্মভাবে লিপিষ্টিক মেখেছেন। লাইনার পেন্সিল ব্যবহার করে থাকবেন বলে মনে হচ্ছে। ভুরু অলিম্পিক ব্যাটারির লোগো যেমন ধরনের, বিদ্যুতের চিহ্নের মতো, অনেকটা সেভাবে পরিচর্যা করা। সব মিলিয়ে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে তাকে, পরিপাটি হয়ে যে আজকের মিটিংএ এসেছেন, তা চোখে এড়ায় না। পরিধানের ব্লাউজটি রেজার জন্য আগ্রহ উদ্দীপক। বন্ধনীর স্থানে ঝুল বেশ খানিকটা নামানো থাকায় অদ্ভুত আকর্ষণ জাগাচ্ছে। এটা যে পরতে পরতে ছোট হয়ে স্তনসন্ধি দেখা যাচ্ছে তা মনে হয় না। সচেতনভাবেই হুকের উপরিভাগ শর্ট রাখা হয়েছে আবার পাতলা শাড়িটি দিয়ে বুকের উপর আবডাল তৈরির চেষ্টা হয়েছে। যদিও তেমন কিছুই আড়াল হয়ে যায়নি। আঁচলের আড়ালে অনিবার্য চোখ আটকানোর স্থানটি নিয়ে রেজার আপত্তি হচ্ছে না, আনন্দই হচ্ছে বরং।

আমি ভাইয়া আছি বিদেশি একটি সংস্থায়। আপনি নাম শুনে থাকবেন . . .। বারিধারায় অফিস আমাদের। এর আগে এফসিএ কমপ্লিট করেছি। আমার মতো এত অল্প বয়েসে এফসিএ শেষের রেকর্ড নেই।

ওয়েল। আপনার মতো আর্লি আর কেউ এফসিএ নেই না তেমন।

আই মিনট ভাইয়া তেমন নেই। ভেরি নমিনাল ইন নাম্বার।

আমি এখন একটি আইপি টিভিতে প্রোগ্রাম করি। অনেক ভিউয়ার। কিন্তু এখন একটি রেগুলার, মেইনস্ট্রিম চ্যানেলে প্রোগ্রামে কাজ করতে চাই।

এরকম ঘণ্টাখানেকের আলাপ চলল। চা-পান পর্ব হলো। বিদায়ের আগে রেজা তাকে গাড়ি দিয়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলেন। না-না করে আপত্তি জানিয়ে তেহরিন বললেন তাহলে তাকে বাড়ি থেকে একটু দূরেই নামতে হবে, না হলে এই লিফট নেওয়া অন্যের গাড়িতে তার পরিবারের সদস্যরা মানবে না (!)। ঠিক হলো বাড়ির কাছেই একটি এটিএম-এ টাকা তোলার ছল করে সেখানে নেমে, বাকিটা পথ হেঁটে যাবেন। রেজা অফিসেই থেকে গেলেন। গাড়ি ফিরলে তিনি বের হবেন। এই সময়ে কিছু কাজ সারবেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন রেজা। এবারই আরেকটি চমক চোখে পড়ল। তেহরিন পিঠ খোলা ব্লাউজ পরেছেন। শিশুদের বর্ণমালা শেখার স্লেট, হালের হোয়াইট বোর্ডের মতো প্রশস্ত পিঠ, দৃষ্টিনন্দন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু লাল, কালো তিল দৃশ্যমান। কনট্রাস্ট বলা যায়। সুযোগ পেলে লাল ও কালো তিল গুণে মনে মনে একটি সারণী তৈরি করতেন। ঝটিকা দেখায় এতটুকু নিশ্চিত হলেন কালোর চেয়ে লালের সংখ্যা ঢের বেশি। বিদায় পর্বের অল্প সময়ে তা আর হয়ে ওঠে না। তবে সিনেমার শেষ দৃশ্যের ক্লাইমেক্সের মতো পিঠখোলা পরিধেয়ের সুবাদে বিদায় পর্বটি আলাদা দ্যোতনা তৈরি করে দিল। রেজা বললেন, আপনি একদমই ভাববেন না, আমি সাধ্যমতো করব।

এরপর কয়েকদিন আর যোগাযোগ হয়নি। এর মধ্যে একটি দুঃখজনক সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধসহ প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে। এ খবর টিভিতে জেনে রেজা মোবাইলে একটা ফোন করলেন তেহরিনকে। ফোন করে জানলেন তেহরিন অফিসে। সে কিভাবে ফিরবে এই অবরোধের মধ্যে তা নিয়ে রেজা তার উদ্বেগ জানালেন। তেহরিন জবাবে বলল, আমার স্বামীর তো এসব খেয়ালই নেই। ওর এসবে কিছু এসে যায় না। কোনো ভাবনাই নেই আমার জন্য। সেখানে আপনার কনসার্ন যে কত ভালো লাগল, বলে বোঝাতে পারবো না। এ কথায় বাকবাকুম হয়ে পড়েন রেজা। এরপর নানা রকম কথা হয়। আরও খানিকক্ষণ।

তেহরিনকে নিয়ে কিছুটা আগ্রহ থেকে একদিন গাড়ি ব্যবসায়ীকে ফোন করে রেজা। কারণ সেদিন অফিসে তেহরিনের কথার সাথে তাকে যে পাঠিয়েছিলেন সেই ব্যবসায়ীর বলা কথার বেশ গড়মিল পায় রেজা। গাড়ি ব্যবসায়ীকে সে ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করায় বেশ অনিয়ন্ত্রিতভাবে সে বলে, ও এসব বলছে। . . . ও নিজে কী। ওতো এর আগেও একটা বিয়ে করছিল। সেটা ছেড়ে এখন যাকে করছে সে তো রোজ রোজ মারধর করে। দু’জনেই একসাথে মিলে নেশা করে। একদিন স্বামী ওকে গাড়ি থামায় হাতিরঝিলে ঠেলে ফেলে দিচ্ছিল। পরে আমাকে ফোন দিলে আমি উদ্ধার করি গিয়ে। আর ও আমাকে নিয়ে . . .। এসব শুনে রেজার ভালো লাগে না। সে আর কথা বাড়ায় না। ফোনে দ্রুত কথা শেষ করে।

এরপর বছর দুই কেটে যায়। রেজার বদলি হয়েছিল ঢাকার বাইরে। এই দুই বছর টুকটাক যোগাযোগ। মেসেজে শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। ঈদে-পার্বণে। খুব বেশি যোগাযোগ না হলেও এ সময়টায় সম্পর্কটা সবার অলক্ষ্যে পুরাতন হয় কিছুটা। নতুন নতুন পরিচয় ও আলাপের যে আনকোরা আর আনুষ্ঠানিক আবহ তা ভাঙ্গার জন্য এ বিষয়টা জরুরি। সম্পর্ক পুরাতন হলে গাঢ় হয়, অধিকার বাড়ে এবং বিশ্বস্ততার একটা বন্ধন তৈরি হয়। প্রথম প্রথম দুইপক্ষেরই আশাহত কিংবা প্রতারিত হওয়ার একটি ঝুঁকিবোধ থাকে তা ক্রমেই তখন কেটে যায়। এ সময়ের মধ্যে রেজাকে ছাড়াই একটি প্রোগ্রামে সুযোগ লাভ করে বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করে আসছিলেন তেহরিন। সেখানে একদিন সময়মতো উপস্থিত না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আরও অভিযোগ ওঠে তিনি মেকআপ আর্টিস্ট, প্রডিউসার, কাস্টিং এডিটর, অন্যান্য কলাকুশলীদের সাথে প্রায়ই খারাপ ব্যবহার করেন। হয়তো অব্যাহতি দেওয়ার আলোচনাও শুরু হয়েছে, এমনটা টের পান তেহরিন। এসব নিয়ে রেজার সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চান। তারা দেখা করার জন্য বেছে নেন ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের সুগার অ্যান্ড স্পাইস নামের রেস্তোরাঁ। সেখানে রেজা পৌঁছানোর পর ফোন করেন তেহরিনকে। জানতে পারেন পাশেই একটি পার্লারে পরিচর্যা গ্রহণের শেষ পর্যায়ে, কিছুক্ষণেই আসছেন। সেদিন বেশ অদ্ভুত দেখায় তেহরিনকে, রেজার কাছে। গায়ের রঙটা প্রথম দিনের মতো ফর্সা নয় বরং বেশ কালো। সে পরেছিল একটি পালাজ্জো ধরনের ঢোলা পাজামা, ঘরোয়া কুর্তা। অনেকটা সাভানা নারীদের সদৃশ। চুলেও জেল্লা নাই, তবে সেটা পুরাপুরি আফ্রিকা মহাদেশের ঐসব অঞ্চলের নারীদের মতো ছোটছোট অনেক গোছায় বেণি বাঁধা না, তাও ঠিক। শরীরে লেগে আছে উপটানসহ নানা ভেষজ পরিচর্যা সামগ্রীর ঈষৎ কটু গন্ধ। অবশ্য তেহরিনও বললেন, আজ দ্রুত বাসায় যেতে হবে, শাওয়ার নিতে হবে। খাবারের অর্ডার করা হলো। তেহরিন বললেন, মাশরুম স্যুপ, গার্লিক বান। রেজা একটি মিডিয়াম স্টেক চাইলেন, রিব আই কাট, ডিপ গ্রিলড, সাথে ক্যাফে মোকা। এসবের পর ঢাকায় এবার বদলি হওয়ার আগের স্টেশন সিলেট থেকে আনা মণিপুরী ঐতিহ্যবাহী পোশাক আর হ্যান্ড মেইড একটি কসমেটিকস কীটব্যাগ এগিয়ে দিল তেহরিনকে। মণিপুরী ব্লাউজ ও আজানু লম্বিত স্কাটের মতো পোশাকটি। এটি খুবই বর্ণিল সুতার ব্যবহারে হ্যান্ডলুমে বুননকৃত কাপড় দিয়ে তৈরি। যিনি পরবেন তারই মনটা খুশি খুশি হয়ে যায়। প্যাকেটের মাথাটা কিঞ্চিত খুলে দেখে খুবই আনন্দিত হলো তেহরিন। টিভি স্টেশনে তার সমস্যা নিয়ে আলাপ করলেন। কথাগুলো বলতে বলতে তার স্বর চড়া হয়ে উঠল। বলার ভঙ্গিমা খুবই রাগান্বিত, ক্ষুব্ধ। রেজা তাকে অনুরোধ করে বললেন, আস্তে-আস্তে, অন্যরা শুনবে। এতে আরও ক্রুদ্ধ স্বর বাড়িয়ে তেহরিন বললেন, আরও ভাইয়া বলে কি না, অমি ওভার এজড, আমরা আমাদের স্টেশনে আন্ডার থার্টি প্রেফার করি। আপনারটা স্পেশাল কেস ছিল। আপনি বোটা (রোটেশন) মিস করে ফেলেন। এত কেয়ার ফ্রি আপনি . . .। রেজা আশ্বস্ত করেন সে তার যে ইন্সপেক্টর এরিয়াটি দেখেন তাকে দিয়ে ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলাবেন। তেহরিন এক্সকিউজমি বলে ওয়াশরুম ব্যবহার করতে উঠে যায়। বিল আসে, রেজা মিটিয়ে দেয়। তেহরিন ফিরে বিলের কথা জানতে চায়। রেজা বলেন, দিয়ে দিয়েছি। রিফান্ডটা দিয়ে যাবে।

এবার ছোট খাটো একটা হৈচৈ করে বসে তেহরিন বিল দেওয়া নিয়ে। বলেন, আপনি আমাকে আন্ডারমাইন করলেন। আপনি ভাবছেন আমার কাছে তেমন টাকা নেই। এত তড়িঘড়ি করে বিল মিটালেন তাই। রেজা বলেন, না-না। এমন কিছু না। আরেকদিন আপনি দিবেন। তাহলেই হয়ে যাবে।

নানা রকম ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তেহরিন। এসব নিয়ে সময় অসময়ে রেজার সাথে মোবাইল টেলিফোনে ভালোমন্দ আলাপ করায় এ সময়টায় অভ্যস্ত হয়ে যায় সে। সমস্যা নিয়ে আলাপগুলো সাধারণত সকলেরই দীর্ঘ হয়। সমস্যার বর্ণনা, খুঁটিনাটি, পরামর্শ গ্রহণ-বর্জন, তারও পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি বলতে-শুনতে সময় লাগারই কথা। শেষ পর্যন্ত প্রোগ্রামের উপস্থাপিকার সুযোগটি হাতছাড়া হয় তেহরিনের। সে হন্যে হয়ে অন্য কোথাও বিকল্প সুযোগ খুঁজতে থাকে। এসময় মেজাজটাও খিটমিটে হয়ে থাকে তার। তার বিষয়টি এরকম আজকে হলে আজ, এখন হলে এখনই তার কনফার্মেশন চাই। রেজার মনে হয়, কিছুদিন বিরতি নিলে এমন কী ক্ষতি। টিভিতে নিজেকে দেখাতেই হবে, এমন কেন ব্যাপারটা। কত ভালো ক্যারিয়ার, চাকরিতে আরও সময় দেওয়ার দরকার আছে, সেটা দিলে রিটার্নও ভালো। মেধা আছে, ভালো ডিগ্রি আছে, রেজাল্ট ভালো। তাহলে টিভির মাধ্যমে গ্লামার ছড়ানোর এত আকাঙ্ক্ষা কেন। এটা মেধার নিদারুণ অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু তেহরিনের সকাল বিকেল একই কথা। তার টিভি স্ক্রিনের বাইরে বেশিদিন থাকা চলবে না। ভালো চাকরি এবং অন্য পটেনশিয়াল থাকা সত্ত্বেও গ্লামার প্রতিষ্ঠায় তেহরিনের প্রাণান্ত হওয়া অবাকই লাগে কখনো কখনো রেজার। সেই মুহূর্তে তেহরিন এখানে ওখানে সিভি, অডিশন, সেকেন্ড অডিশন দিচ্ছেন। রেজাকে চাপ দিচ্ছেন তার জন্য বলিয়ে দিতে। সেই বলানো ব্যাপারটা আবার একবার না কয়েকবারে করার অনুরোধ থাকে তার। আবার অল্প ব্যবধানেই ফলোআপ জানারও আবদার থাকে। একটি জায়গায় প্রায় হয়ে আসছিল। তার সরাসরি উৎপাত আর তার হয়ে তদবিরকারীদের বারবার বলায় বিগড়ে যায় ম্যানেজমেন্ট। সিইও মঈন মিয়াজী সহকর্মীদের সামনে বলেই ফেলেন, এখনই এত তদবির করাচ্ছে, এরপর কাজ শুরু হলে তো তার হাঙ্কি-পাঙ্কি আর ড্রামাকুইনগিরিতে কাজই করতে পারব না। বাদ দাও এরকম লোক আমাদের চলবে না। সে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, ওটাই ওকে মন দিয়ে করার কথা তোমরা কেউ জানিয়ে দিও। আবার আমাকে যেন মেইলের পর মেইল করতেই থাকল, এমন আর না হয়। বইলো মঈন ভাই আপনাকে শুভকামনা জানিয়েছে।

রেজা লক্ষ্য করেন, এই সময়টায় ফেসবুকে তেহরিন হোসেন আইডির নিত্যনতুন সজ্জার নিজের ফটোশুটের ছবি পোস্ট করা বেড়ে গেছে। নানা ঢং-এর ছবি। নিজেকে যতটা আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায় তার নিখুঁত চেষ্টা আছে বোঝা যায়। তেহরিন মনে করেন তার পিঠ খোলা ছবি খুবই আকর্ষণীয় হয়। ছবিও দেখে রেজার তেমনই ধারণা জন্মে। সে লক্ষ্য করে বেশিরভাগ ছবিতেই সে পিঠ উন্মুক্ত পোশাক পরে আছেন। একটা ছবিতে চোখ লাগে, আবক্ষ উন্মুক্ত পশ্চিমা জামা পরিহিতা, দুই কাঁধের উপর থেকে দুটি বেল্টে কেবল আটকে আছে, আপকোসেট ধরনের। শাড়ি পরা ছবিগুলির মধ্যে আঁটসাঁট কিছু ছবিও আছে, শাড়ি জড়িয়ে পরা, পিঠ ছেড়ে রাখার মতো কিছু না সেগুলো। কিন্তু সেগুলোর পরিধান সৌকর্য আবার অন্যত্র। পরিধান কৌশলে ও ছবির এঙ্গেলে, যে শটগুলো উপর থেকে ক্যাপচারড, সেখানে স্তনের সৌন্দর্য ও প্রকাশ অনুপমভাবে ঘটেছে। অথচ আরও কিছুদিন পরে রেজা অবমুক্ত সেই অমিত আকর্ষণীয় স্তনযুগল যখন বারবার ছুঁয়ে দেখার মতো সৌভাগ্য লাভ করে, সে আবিষ্কার করে ফেসবুকে যা দেখা হয়, সর্বাংশে তা সত্য নয়, সেটাই বড় সত্য। অতি অসম আকৃতির স্তনদ্বয় খালি ফোমের কৃত্রিম মোড়ক, পরিধান কৌশল আর ছবি তোলার গুণে বিজ্ঞাপনে লেখার অনুরূপ ‘পীনোন্নত ও সুডৌল’ বলে এতদিন মনে হয়েছে, সে তেমন কিছুই নয়। কিন্তু হাতে ছুঁয়ে মনে হয়েছে কিনলে পানির নরম বোতলের চেয়েও যেন বা বেশিই দাবানো যায় অনায়াসে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো একই মানুষকে তিন পোশাকে তিনরকম লাগে। শাড়িতে এক চেহারা, সালোয়ারে আরেকরকম আর পার্লার ফিরতি অবিন্যস্ত চুল ও প্রসাধন বিহীন আরও অন্য রকম।

সকাল-সাঁঝে টাইম টেবিল ছাড়া ফোনে দফায় দফা সমস্যা ছাড়াও নানারকম কথাবার্তাই হয় তেহরিন-রেজার। চলমান যাপিত জীবন, সাম্প্রতিক ঘটনা বা দুইজনের কমন পরিচিতদের নিয়েও আলাপ হয়।

একদিন ফোনে তেহরিন বললেন, আমার এক বান্ধবী, আমার সাথে স্কুল-কলেজ একসাথে পড়ছে, আপনার শাওন ভাই’র নামে কমপ্লেইনের কথা ভাবছে। সে অনেক আপসেট। শাওন ভাই তার সাথে ম্যালাইন করছে অনেক বড়। ও কিছুতেই মানতে পারছে না। সে মেন্টাল হেলথের ডক্টরের অ্যাপয়েন্টমেন্টে যাবে। ওর মেডিকেশনে চলে যেতে হবে। এতটাই শকড্ সে। রেজা বললেন, কিন্তু শাওন ভাইতো হ্যাপিলি ম্যারিড। আপনার বান্ধবী জানতেন না।

জানত।

তাহলে কমপ্লেনের গ্রাউন্ড কী?

ওর লাগছে। রিসেন্টলি জানতে পারছে উনি এরকম রিলেশন অনেকের সাথে রাখছে।

ওনার ওয়াইফ কোন কনফ্লিক্টিং ইস্যু না ওর জন্য।

মনে মনে রেজা বলেন, বাপরে বাপ। মাফও চাই, দোয়াও চাই। মনের কথা চেপে যেয়ে মোবাইল ফোনের রিসিভারের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, বান্ধবীর নাম কী?

সেটা বলা যাবে না। সে মনে হয় শাওন ভাই’র অফিসের বসদের মেইল দিয়ে জানাবে। . . .

আরেকদিন কথায় কথায় বলেন, আমার আগে একটা বিয়ে হইছিল। আমাদের পাড়ায়ই থাকতো ওরা। আমার বয়স তখন কম, উঠতি বয়সের ইমোশন, হুটহাট করে ডিসিশনটা হয়। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়ের ঘটনা। এটা নিয়ে পারিবারিক বসাবসি করে ডিভোর্স হয়। আপনাকে আগে বলিনি।

আমি কিছুটা জানতাম।

কে বলছে, ঐ শয়তানটা। ও এই কথা যে আরও কতজনকে বলছে। মনে হয় জনে জনেই বলে বেড়ায়। এখনো।

মাত্র চারদিনের পর আমি চলে আসি।

কেন। এত শর্টলি?

ওরতো ওয়াইফ আছে, দুই বাচ্চা। আমি ডিভোর্স না দিলে ওর ওয়াইফ মামলা করতে পারত। আমাকে সবাই বুঝাল। তিনদিন পর্যন্ত রাজি হইনি। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম। সারারাত ধরে চিন্তা করলাম। তারপর ডিসিশন নিলাম।

অপর একদিন তেহরিনের মন ভীষণ খারাপ বলে রেজাকে বলল।

আমার মধ্যে একটা ইনফ্যাচ্যুয়েশন থেকে অবসেশন হয়েছিল এ্যাডভাটাইজমেন্টের ক্যাম্পেইনের আউট সোর্সিং কোম্পানির এক্সিকিউটিভের জন্য। এখন সে ফোন টোন ধরছে না। আমার মনটা ভীষণ খারাপ।

একদম ভালো লাগছে না, আমি ওকে ছাড়বো না।

ব্যাপারটা আরেকটু ভেঙ্গে বলতেন যদি।

ছেলেটার নাম রাশেদ। প্রথম প্রথম ওই ইন্টারেস্ট শো করে বেশি। এরপর আমিও অবসেসড হয়ে যাই। তারপর ঘোরাঘোরি করি, দেখা করি। ওর মনে হয় আমরা বেশি জড়িয়ে যাচ্ছি। শেষদিন আমাকে বলে যায় আমি যেন যোগাযোগ বন্ধ না করি কখনো। সেদিন থেকেই ও-ই ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে সবখানে ব্লক করে দিছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।

না-না। এত রাগের কী আছে। আপনারা কি কোনো লংটাইম প্ল্যান করেছিলেন। ওনার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস কী?

না। সেরকম কিছু না। ও-ও ম্যারিড।

তাহলে তো ধরার মতো কিছু নেই। এটা তো সাসটেইন্যাবল কিছু হতো না, জানা কথা। আর আপনি তো হায়ার স্টাডিতে বাইরে চলে যাবেন বলছিলেন। তখনতো এটা ঘটাতেই হতো। আপনার আগে সে ঘটালো।

তবু। আমি মানতে পারছি না। আমি দেখে নেব।

ফিজিক শেয়ারিং হয়েছে?

প্রেম থাকলে তো হতেই পারে। এটা বিগ ডিল না। কিন্তু তার অফ হওয়াটা সাসপেশাস।

নানা কারণ ঘটতে পারে তার দিক থেকে। বাসায় ধরা খেতে পারে। অন্য সমস্যাও ...।

না না না। আমি বুঝতে চাইনা। বলে তেহরিন কেঁদেই ফেলেন।

রেজার মনে হয় পরিচয়ের প্রথম দিকে এরকম আরেকটি ইস্যু বলেছিলেন তেহরিন। এক জার্নালিস্টের সাথে তার উথাল পাতাল প্রেম। মধ্যে মধ্যে হোটেলে হ্যাঙ্গআউট করতেন তারা। এমনও তখন ভাবতেন সব ছেড়ে বিদেশে চলে যাবেন। ঐ উন্মত্ত প্রেমের মাঝেও অভিযোগ ছিল হোটেল ভাড়া তেহরিনকেই দিতে হতো। ইন্টারকোর্স সেরে চলে গেলে রিশাদের আর খবর থাকতো না। হারিয়ে যেত অনেকদিনের জন্য। ইদানীংকালে রিশাদের প্রসঙ্গ তুলে রেজা দেখেছেন, তেহরিনের এখন আর আগ্রহ হয় না লস্ট লাভটা নিয়ে কথা বলতে।

এরমধ্যে টিভিতে নিজেকে দেখানোর আকাঙ্ক্ষায় একটুও ভাটা পড়েনি তেহরিনের। কোথাও রেসপন্স না পেয়ে সে প্রথম জীবনের আইপি টিভিটায় অনুষ্ঠান বিভাগে ফিরে যায়। সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব মিলিয়ে কিছু ভিউয়ার যে নেই তা না। তবে এটা অবনমনই বলতে হয়। সেখানে কাজ করতে করতে এক দু’মাসেই আবার ঝামেলা। একটা হলো তাকে প্রাইম শো না দেওয়ার অভিযোগ তেহরিনের। কারা আবার বলে বেড়াচ্ছে একদিন হঠাৎই আনশিডিউলড শো’ লাগায় তাড়াহুড়ো করে অফিসে শাওয়ার নিতে টয়লেটের পুশ শাওয়ার, যা দিয়ে কি না শৌচকাজ করা হয়, সেটা ব্যবহার করেছেন। এসবের মুখে সে রেজার কাছে জানতে চায়, কী করব? আমি রিজাইন করি। রেজা বলেন, আপনি যেমন বলেছেন, ওরা আপনাকে কোনো পেমেন্টও করে না, তাহলে ওখানে প্রোগ্রাম করার চেয়ে রিজাইন করে ঘরে বসে বিশ্রাম নেওয়াও ভালো। আপনি রিজাইন করেন।

রিজাইন তিনি করতেনই। রেজার কাছে শুধু সমর্থন চাওয়া। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রেজাও জোর দিয়েই বলে রিজাইন করতে। এতেই দায়বদ্ধতায় তাকে আটকে ফেলেন তেহরিন। এরপর প্রায়ই বলতে থাকেন, আমি ভালোই ছিলাম, আপনার কথায় আমি রিজাইন করলাম, এখনতো আপনার ভরসায় রিজাইন করে কোথাও নেই আমি, আপনি আমার মিডিয়া ক্যারিয়ারটা ধ্বংস করলেন, আপনার কথা শুনে আমার রিজাইন দেওয়াটা ঠিক হয়নি, কী যে ভুল করলাম . . . । রেজা নানামুখী চেষ্টা করেন এই সমালোচনা থেকে বাঁচতে। যদিও তা ভিত্তিহীন, যুক্তিহীন, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। একটা টিভি স্টেশনে কথা হয়। তারা জানায় একমাসের মধ্যে নিয়ে ফেলবেন। বাংলাদেশে যা হয় আরকি, একমাস মানে একমাস নয়। তাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজিএমইএ’র নির্বাচনে ব্যস্ত থাকায় অফিসে সময় দিতে পারলেন না দীর্ঘদিন। এরপর চলে গেলেন আমেরিকায়। ঝুলে থাকল বিষয়টা। এদিকে নাছোড়বান্দা তেহরিন, রেজাকে বারবার তাগাদা দেন, ঐ এক কথা আপনার জন্য রিজাইন করছি আমি। কিছুই বুঝতে চান না, একমাসের সময়সীমা প্রলম্বিত হচ্ছে কেন এটাই তার কথা। রেজা এরমধ্যে হাড়ে হাড়ে টের পান, কী অস্থির আর উগ্র মানুষটি! সেফোরার দামি প্রসাধনীর সজ্জাও তা আড়াল করতে পারে না। কোনোকিছু ছিমছাম করে সম্পন্ন করার মতো মানুষই না যেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে ঝামেলা বাধানো, চিৎকার-চেঁচামেচি অসহিষ্ণু হয়ে গালাগাল করা তার নিত্যদিনকার ব্যাপার।

এই টিভি প্রোগ্রামের সুযোগ লাভের চেষ্টার দিনগুলোতে একদিন রেজার সাথে দেখা করতে আসেন তেহরিন। সেদিনও সেজেগুজে পরিপাটি হয়েই আসেন যথারীতি। হাতে একটা ডিওরের ব্যাগ। রেজা জিজ্ঞাসা করেন, এটা কি আসল না রাজধানী সুপার মার্কেটের হোলসেল থেকে কিনছেন? খুবই ক্ষেপে যেয়ে তেহরিন নিশ্চিত করেন হ্যান্ডব্যাগটি আসল ডিওর ব্র্যান্ডের। সেদিন ছিল বসন্তের প্রথম দিন। কোথাও বসার মতো জায়গা না পেয়ে তারা একটি মাঝারি ধরনের ভালো হোটেলের মোটামুটি বড়সড় কক্ষে এসে বসেন। এসব আবাসিক হোটেলও যেহেতু রেজার ডিপার্টমেন্টের মুখাপেক্ষী হোটেল ম্যানেজারকে বলা মাত্রই সব হয়ে যায়। কোনো ডকুমেন্টের বালাই থাকে না রিসিপশনে বা রেজিস্টারে এন্ট্রি পর্যন্ত লাগে না। তারা নিরিবিলিতে বসে ভালো সময় অতিবাহিত করার অবকাশ পান অতি সহজেই। তেহরিন প্রথমে হাত পর্যন্ত ধরতে দেবে না বলেও একে একে সবখানেই স্পর্শ করা অ্যালাউ করে। রেজা যে ধৈর্য ও সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন এতদিন তা উশুল করে ছাড়েন। কক্ষ ছাড়ার সময় বিছানা, বালিশ, ম্যাট্রেস, কম্ফোর্টারের ওলট-পালট অবস্থা দু’জনকেই লজ্জিত করে।

সেদিনের পর থেকে রেজা অনেক বেশি অবলিগেটেড হয়ে পড়েন। সে তেহরিনের টিভিতে সুযোগ লাভের জন্য আন্তরিকভাবে জোরেশোরে চেষ্টা করতে থাকেন। ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে বলে প্রায়ই আজকাল বলেন তেহরিন। এর আগেও বিদেশে গেছেন তিনি। ইউরোপে গিয়ে দামি হোটেলেই থেকেছেন। যেখানে অন্যরা আত্মীয় বা বন্ধুদের বাসায় ওঠেন। স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশের শেরাটন চেইনের দামি হোটেল রুমে থেকেছেন বেড়াতে গিয়ে সে গল্প আগ্রহ নিয়ে বলেন।

সেই শাওন ভাই’র সাথে তেহরিনেরও যে একটা যোগাযোগ আছে তা কথায় কথায় একদিন বেরিয়ে আসে। কবে তিনি তাকে ফাঁকা বাসায় যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তেহরিন তো যাননি, রাগ হয়েছেন অনেক। আরেকদিন তারা একটি ক্যাফেতে বসেছিলেন সময় ঠিক করে। শাওন ভাই হঠাৎ বলে বসেন, আমার বাসায় কেউ নেই, কিছু আম আসছে, কুরিয়ারে। রিসিভ করতে যেতে হবে। তুমিও চল? এসব শুনে রেজা বলেন, কেন বাসায় কেউ নেই, আপনাকে আমগুলো তুলে চৌকির নিচে চট বিছিয়ে গুণে গেঁথে রাখতে সাহায্য করার জন্য যেতে বলেছিলেন, উনি? তেহরিন উত্তর করেন, আপনি রেজা ভাই কিছুই বোঝেন না সহজে? রেজা বুঝতে পারেন সেদিনের হোটেল কক্ষে ঘটা ব্যাপারটার পর থেকে তেহরিন যে অ্যাভেইএবল না, সেকথাই নানাভাবে বোঝাতে চান।

একই উদ্দেশ্যে সে পুরান ঢাকার এক বনেদি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের পোশাক-আশাকে ধোপদুরস্ত পার্টিবয় টাইপ ব্যক্তির কথা বলেন। একেও রেজা চেনেন। এরমাঝে কবে নাকি তেহরিনের অফিসে দুমদাম চলে এসে তাকে বলে গেছেন, তুমি শোবে আমার সাথে? তেহরিন এতে অনেক রাগ করেছেন। রাগের পরিমাণটা বোঝাতে তিনি দুইহাত তুলে মেলে ধরেন বড় করে। তার আরেক বন্ধু যার বেসরকারি ব্যাঙ্কেরও মালিকানা আছে, সেই বিত্তশালী ভাইয়াটির সাথে তেহরিনের এক সাবেক সহকর্মীর প্রেম আছে মাখোমাখো। বয়সের অনেক ব্যবধান সত্ত্বেও তাদের দু’জনের আদিখ্যেতার শেষ নেই। দেখলে-শুনলে গা জ্বালা করে তার। এধরনের রিলেশনে একদমই সায় নেই তার, বলে দাবি করেন রেজার কাছে।

একদিন ড্রাইভার না থাকায় তেহরিনকে কিছুটা রাত করে ফিরতে হয়েছিল উবারে করে। সেদিন রেজা তাকে ফোন করলেন। আজকাল রেজাও কখনো কখনো নিজেও ফোন করেন। ব্যস্ততা বা বিরক্ত করতে না চাইলে দু’জনই - দুজনকে এসএমএস করেন। তারা তেহরিনের যাত্রাপথে পুরো সময়টাই ফোনে কথা বললেন। ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে লিফটের বোতাম টিপে অপেক্ষারত অবস্থায় তেহরিন রেজাকে বললেন, সত্যি করে বলুন, আপনি আমার সিকিউরিটি ভাবনায় পুরো পথে ফোন ধরে ছিলেন তাই না? যদিও এমন কিছু না কিন্তু রেজা হ্যাঁ সূচক উত্তর করলেন।

ঐদিন রাতেই তেহরিন ফোন করলেন রেজাকে। কিছুটা ভূমিকার অবতারণা শেষে বলেন, আপনাকে আগে কখনো জানানো হয়নি, আজকে বলছি, আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে বেশ কয়েক বছর আগে, আমাকে এজন্য প্রতিমাসে স্টেরয়েডও নিতে হয়। শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান রেজা। তার তীব্র বেদনাবোধ হয়। একটা নরম কোমল মমতা জাগে মনে। সে মুহূর্তে একটা কান্নাও জাগে মনের গভীরে। তেহরিনের প্রতি মনোভাবই বদলে যায় একথার পর। যদি সে এরপর এনিয়ে আর কখনো কিছু তেমন জানতে চাননি। মনে হয়েছে বিষয়টি ব্যক্তিগতই থাক।

যখন তেহরিনের কথাটি তার সত্য বলে মনে হয়েছে তখন গভীর দুঃখ জেগেছে মনে। আবার ক্যান্সারের ব্যাপারটি সত্য নয় এমনও মনে হয়েছে। এটা মনে হয়েছে এতদিনে রেজা তেহরিনকে যেমন জেনেছেন, তারই ভিত্তিতে। রেজার ভাবনায় এসেছে হয়তো এজন্য তার মেজাজ চড়া থাকে, অল্পতে রেগে যান। আবার মনে পড়ে এরমধ্যে তেহরিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু জাকারিয়ার সাথে তার কথাটি তোলায়, জাকারিয়ার মন্তব্যটি। জাকারিয়া বলেছিলেন, ভাই একটা পিছ, ওয়ার পিছ মেড কারিগর ডেড টাইপের কিছু একটা। জাকারিয়ার কথা মানলে ধরতে হয় সে ছাত্রজীবন থেকেই এরকম।

পরিবারের সদস্যদের বিষয়েও কথাবার্তা হয় রেজার সাথে। একমাত্র বাবা ছাড়া কারও ব্যাপারে অভিযোগের কমতি নেই তার। মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি যাচাই বাছাই না করে ভাইয়ের বিয়ে পাকা করেছিলেন। আর ভাইয়ের বউকে সে ডাইনি, রাক্ষসী, মায়াবিনী, যাদুকারিনী ... এসবের বাইরে অন্যকিছু ভাবেন না। ভাই হলেন যাদু-তুকতাকের নিরীহ শিকার। প্রসঙ্গক্রমে তেহরিনও রেজাকে জিজ্ঞাসা করেছেন , আপনার বউ কখনো আপত্তি করে না , কথা বলা নিয়ে অন্য মে’দের সাথে?

আমি স্বাধীন সার্বভৌম মানুষ,বলতে পারেন এ শহরে একমাত্র আত্মসম্মান সম্পন্ন আসল পুরুষ মানুষ। এ জাতীয় হেঁয়ালি ছাড়া রেজার ফ্যামিলি অ্যাফেয়ারে আর কিছুই জানতে পারেনরি তেহরিন।

এরমধ্যে বিশিষ্ট শিল্পপতি আজিজ ভাই’র সাথে তেহরিনের পুরাতন জানাশোনা সচল করার কথা জানালো রেজাকে। আজিজ ভাই’র পিএস মি. ইমনের সাথে পুরো এক বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি আনন্দ আড্ডায় কাটানোর গল্প শুনতে হল রেজাকে। আজ তার আজিজ ভাই’র জন্য এটা কিনছেন, কাল ওটা অর্ডার করছে, এমন হরেক গল্প ফেনিয়ে ফেনিয়ে রেজার কাছে করল কিছুদিন। কিন্তু সেখান থেকে তেমন প্রত্যাশা অনুযায়ী রাতারাতি কিছু না ঘটায় এক রাতে ফোনে অনেকক্ষণ রেজার কাছেই হাউমাউ করে করুণভাবে কান্নাকাটি আর জীবন নিয়ে আফসোস করলেন। অশ্রুপাতে রেজার প্রকৃতপক্ষে খারাপই লাগল, তবে জীবন নিয়ে আফসোসটুকু বিলাসী কষ্ট বলে প্রতিভাত হল। এরমাঝে অনেকদিন ঘুরে ঘুরে অবশেষে টিভি স্টেশনগুলো থেকে আশাব্যঞ্জক খবর আসতে শুরু করল। একটি স্টেশন জানালো তারা খণ্ডকালীন নয় বরং ফুলটাইমার ভিত্তিতে তাদের টিভিতে লোক নেবে, তেহরিন চাইলে যোগ দিতে পারেন। কিন্তু তার বিদেশি সংস্থার অতভালো বেতনের চাকরির জন্য ফুল টাইমার হওয়ার শর্ত পূর্ণ অফারটি ছেড়ে দিতে হল। যদিও ঐ স্টেশনটির খুবই উচ্চ টিআরপি ছিল। আরেকটি টিভি চ্যানেল জানালো তাদের লোক ঘাটতি নেই, তবু তেহরিনকে সপ্তাহে দু’দিন করে তারা সুযোগ দিতে পারবেন। নির্ধারিত সময়টা অফপিক আওয়ারই বলা চলে। কনফরমেশনের খবরগুলো রেজা তার মতো করে জেনে নিয়েছিলেন। এসময়েই তেহরিনের এসএমএস এলো, আমাকে একটি স্টেশন কনফর্ম করেছে। আজিজ ভাই ইজ গ্রেট। তার জন্যই সম্ভব হল। আপনাকেও ধন্যবাদ। তবে আমি যোগদান করছি না। অফারটি অফপিকের তাই ভালো লাগেনি।

কৃতিত্ব না দেওয়ার এ ঘটনায় রেজা খুবই মর্মাহত হলেন। সে মুহূর্তে তেহরিনের সাথে তার যাবতীয় তিক্ত অভিজ্ঞতা একে একে মনে পড়ল। এ দিনের পর থেকে তেহরিন ও রেজার মাঝে কখনই আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

ততদিনে রেজা বুঝে গেছেন, তেহরিন তার অতিরিক্ত অস্থির চিত্তের জন্য নানা জাটিল্যে বাধা পড়েছেন। উগ্র মেজাজ তার কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যা তৈরি করছে। সহজলভ্যতার জন্য তিনি হাসির পাত্র হচ্ছেন। বড় বড় কথা, অযৌক্তিক আলাপে বিতর্কিত হচ্ছেন। সিদ্ধান্তহীনতায় তিনি অনেকটাই গতিহারা। একদমই ধৈর্য ধরতে অপারগ বলে হালকা হচ্ছেন অন্যদের কাছে। ইতিমধ্যে রেজার গভীর উপলব্ধি হয়েছে মেধাবী বা প্রতিভাময়ী হওয়াই জীবনে যথেষ্ট নয়। কর্মক্ষেত্রে সুনাম ও কর্মপরিবেশ ভালো রাখতে অবদান থাকতে হয়। না হলে অপরাপর সহকর্মীরা পেছনে লেগে কর্মজীবন বিষময় করে ছাড়ে। এটাই হয়ত স্বাভাবিকও। সহকর্মীবান্ধব, সহাবস্থান বজায় রাখা ও সুনামের অধিকারী হতে না পারলে যোগ্যতা-দক্ষতা যতই থাকুক ভালো করা যায় না।