স্বতঃস্ফূর্তভাবে করোনার টিকা নিতে আসছেন নারী পুরুষরা/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও প্রাণহানির লাগাম টেনে ধরতে রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে গণটিকা প্রয়োগ কার্যক্রম। আজ তথা সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ছিল এ টিকা প্রয়োগ কার্যক্রমের দ্বিতীয় দিন। দুদিনে দেশব্যাপী করোনা থেকে বাঁচতে টিকা নিয়েছেন ৭৭ হাজার ৬৬৯ জন। এর মধ্যে প্রথম দিন নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০; দ্বিতীয় দিন নিয়েছেন ৪৬ হাজার ৫০৯ জন। দুদিনে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে মাত্র ৯২ জনের দেহে।

এর মধ্যে প্রথম দিনেই করোনার টিকা নেওয়ার পর ২১ জনের দেহে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। তবে এ খবরে থমকে যায়নি টিকা কার্যক্রম। বরং মানুষের মাঝে টিকা নেওয়ার বিষয়ে বেড়েছে আগ্রহ। কেননা প্রথম দিনে যেখানে টিকা নিয়েছেন ৩১ হাজার ১৬০ জন। দ্বিতীয় দিনে এর সংখ্যা প্রায় দেড়গুন বেড়েছে। আজও ৭১ জনের দেহে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

টিকা পেতে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সর্বমোট অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছেন পাঁচ লাখ ১২ হাজার পাঁচ জন। গতকাল যা ছিল চার লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে টিকা পেতে নিবন্ধনের সংখ্যা বেড়েছে লাখের বেশি।

দ্বিতীয় দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত দেশের এক হাজার পাঁচটি কেন্দ্রে স্থাপিত বুথে টিকা দেওয়া হয়। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও টিকাদান কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, গতকালের তুলনায় আজ টিকাদান কেন্দ্রে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে। টিকার বিষয়ে নানা গুজব উঠলেও কেন্দ্রে আসা মানুষের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে।

টিকায় আগ্রহ বাড়ছে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে

প্রয়োগের প্রথম দিনে সচিবালয়ের ১৬৭ জন করোনার টিকা নিয়েছেন। কার্যক্রমের দ্বিতীয় দিনে টিকা নেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে আরও ৯০ জন। সবমিলিয়ে, সচিবালয়ে টিকা গ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫৭ জনে। টিকা নিয়ে অন্যদেরও নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। এ দিন বিকেলে সচিবালয় ক্লিনিকের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী ঢাকা পোস্ট-কে এ তথ্য জানান।

দুপুরে সচিবালয় ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, উৎসাহ নিয়ে টিকা নিচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। টিকা নেওয়ার পর ১০ থেকে ২০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে তারা ফের কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন। সচিবালয় ক্লিনিকে মোট ১২ দিন এ কার্যক্রম চলবে।

করোনার টিকা নিতে মানুষের অপেক্ষা/ ছবি: সংগৃহীত

বিএনপি নেতাও নিলেন টিকা

করোনার টিকা ভারত থেকে আনা ও এর প্রয়োগের বিষয়ে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির অনেক নেতা সংশয় প্রকাশ করলেও সেই টিকা নিয়েছেন দলটির নেতা মাহবুব উদ্দিন খোকন। টিকা নিয়েই জানিয়েছেন, ‘ভালো’ বোধ করছেন।

সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ নেন ৬৫ বছর বয়সী এই আইনজীবী, যিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্বে আছেন।

টিকা নেওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘মেন্টালি বেটার ফিল (মানসিকভাবে ভালো বোধ) করছি। টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না- তা বলতে পারছি না। তবে আই এম ফিলিং বেটার।’

টিকা নিলেন খাদ্যমন্ত্রী ও নৌ প্রতিমন্ত্রী

গণটিকা প্রয়োগের প্রথম দিনেই বেশ কিছু মন্ত্রী-এমপি ও সচিবরা করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন। দ্বিতীয় দিনে এসে টিকা নিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) শ্যামলীর টিবি হাসপাতালে খাদ্যমন্ত্রী টিকা নেন। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ)। 

টিকা নিয়েই সাধন চন্দ্র মজুমদার সবাইকে এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের জনগণের জন্য টিকার ব্যবস্থা করায় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।

টিকা নেওয়ার পর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, জীবনে অনেক টিকা নিয়েছি। করোনার এ টিকাও আলাদা কিছু না। আমি এখন মহামারি করোনা ফ্লু-মুক্ত; এটা আমার বিশ্বাস। সবাইকে টিকা নিতে হবে। বিশ্ব মহামারি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সবার করোনার ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ।

টিকা নিতে আসা নারী পেলেন লাল গোলাপ/ ছবি: সংগৃহীত

ভ্যাকসিন নেয়ার আহ্বান সালাহউদ্দিন ও বিবি রাসেলের

দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম কিংবদন্তী এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও বিশিষ্ট ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল দুপুর সাড়ে ১২টায় করোনার টিকা নিয়েছেন।

দুজনই টিকা নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই মিডিয়ার সামনে এসেছেন। দেশের অন্যতম সেরা ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল সবাইকে ভ্যাকসিন নেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকে শঙ্কার মধ্যে রয়েছে ও কিছুটা গুজবও রটাচ্ছে। আমি স্পষ্ট বলতে চাই, সকলের সুস্থতার জন্য ভ্যাকসিন নেয়া প্রয়োজন।

সালাউদ্দিনও বিবি রাসেলের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, আমাদের নাগরিকদের মধ্যে যারা আগ্রহী রয়েছেন, তাদের দ্রুত ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা আপনারা করবেন সেই প্রত্যাশা রইল।

ঢাকা উত্তরে ২৬ কেন্দ্রে টিকাদান

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার ২৬টি কেন্দ্রে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২১টি কেন্দ্র সরকারি হাসপাতালে। বাকি পাঁচটি কেন্দ্র ইউপিএইচসিএসডিপির আওতায় পরিচালিত মাতৃসদনে।

এসব কেন্দ্রে সকাল থেকেই টিকা নিতে আসা মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এসব কেন্দ্রে টিকা নিতে আসা মানুষের মাঝে দেখা গেছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা।

করোনার টিকা নিচ্ছেন এক ব্যক্তি/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রগুলো হলো- বাংলাদেশ সংসদ সচিবালয় ক্লিনিক; ঢাকা ডেন্টাল কলেজ; ঢাকা শিশু হাসপাতাল; সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল; কুয়েত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল; কুর্মিটোলা হাসপাতাল; লালকুঠি হাসপাতাল; মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার; জাতীয় বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধ কেন্দ্র; জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল; জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট; জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিউট ও হাসপাতাল; জাতীয় নাক, কান ও গলা ইনস্টিটিউট; জাতীয় কিডনি হাসপাতাল; জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল; ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল; জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল; জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল; শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল; শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল; যক্ষ্মা হাসপাতাল; নগর মাতৃসদন-১ মগবাজার; নগর মাতৃসদন-২ মোহাম্মদপুর; নগর মাতৃসদন-৩ মাজার রোড; নগর মাতৃসদন-৪ পল্লবী এক্সটেনশন এবং নগর মাতৃসদন-৫ উত্তরা।

প্রথম দিন টিকা নেওয়ার পর যা বলেছেন মন্ত্রীরা

রোববার সকাল ১০টায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের পর টিকা নেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিব।

বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তারা করোনার টিকা নিয়েছেন। বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত কোভিশিল্ড নামে টিকাটি। মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম টিকা নিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। 
বেলা ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর মহাখালীতে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে টিকা নেন তিনি। টিকা নেওয়ার পর অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘টিকা নেওয়ার পর আরও শক্তিশালী হয়ে গেছি। কোনো ধরনের সমস্যা বোধ করছি না’।

একই হাসপাতালে টিকা নেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি টিকা নেন। এ সময় গুজব ও অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে জনগণকে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী।

গতকাল দুপুরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সস্ত্রীক টিকা নেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। টিকা নেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমি টিকা নিয়েছি, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই’। সবাইকে টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার থেকে দূরে থাকার অনুরোধ করেন তিনি।

রোববার দুপুর ১টায় সচিবালয়ে ‘সচিবালয় ক্লিনিক’-এ টিকা নেন রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। টিকা নিয়ে তিনি বলেন, ‘অনুভূতি অন্যান্য টিকার মতোই। সকল পর্যায়ে টিকাদান ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক। মন্ত্রী-এমপিরা অনেকেই টিকা নিচ্ছেন, অপপ্রচারকারীরা ব্যর্থ হয়েছে।’ জনগণকে নির্দ্বিধায় টিকা নেওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী।

একই দিন বেলা পৌনে ১১টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। টিকা নেওয়ার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘যেকোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তবে এ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর নিয়মানুযায়ী আধাঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। কোনোরকম সমস্যা অনুভব করিনি।’

জানা গেছে, শুরুর দিন অর্থাৎ রোববার তিন লাখ ৬০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি রেখেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে নিবন্ধন হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। সারা দেশে দুই হাজার ৪০০টি দল টিকা প্রয়োগে কাজ করেছে। টিকা নেওয়ার জন্য আগে থেকে নিবন্ধন করতে হয়েছিল তাদের। এছাড়া টিকাদানকেন্দ্রেও নিবন্ধনের সুযোগ ছিল। প্রথম দিন টিকা দেওয়ার সময় গ্রহীতাকে বলে দেওয়া হচ্ছে দ্বিতীয় ডোজের তারিখ।

সরকার প্রাথমিকভাবে ভারত থেকে ৭০ লাখ টিকা এনেছে। এর ২০ লাখ টিকা ভারত সরকার বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। বাকি ৫০ লাখ টিকা সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কিনে আনা হয়েছে। এই টিকা ৩৫ লাখ মানুষকে দেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই ৭৭ হাজার ৬৬৯ জনের দেহে প্রয়োগ করা হয়েছে এ টিকা।

এফআর