সিপ্তি আহমেদ ও সুইটি আহমেদ দুই বোন। সিপ্তি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে এলসিএলএসে এলএলবি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। সুইটি পড়ছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে সেকেন্ড ইয়ারে। তাদের বাবা শামীম আহমেদ মোহাম্মদপুর এলাকার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বলতে গেলে সোনার চামচ মুখে নিয়ে সিপ্তি-সুইটির জন্ম। কিন্তু করোনার প্রথম ঢেউয়ে পাল্টে যায় তাদের জীবনচিত্র।

করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি হয়ে পড়েন হই-হুল্লোড় করে ঘুরে বেড়ানো দুই বোন। অফুরন্ত অলস সময় কাজে লাগানোর জন্য বেকিং ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথমদিকে পরিবার থেকে বিশেষ করে মা শান্তা আহমেদ প্রবল বাধা দেন। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল দুই বোন মাত্র ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ইউটিউবে দেখে এবং বিদেশি বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে নিজেরা তৈরি করেন বিশ্বমানের কেক। অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন। শখের বসে শুরু করা বেকিং ব্যবসা থেকে এখন দুই বোনের মাসিক আয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

ব্যবসা শুরুর প্রসঙ্গে সিপ্তি ও সুইটি বলেন, করোনাকালীন সবাই ঘরবন্দি ছিলাম। কারও সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। করোনা থেকে কবে মুক্তি পাব সেটাও ছিল অনেকটা অনিশ্চিত। তখনই আমরা দুই বোন ও আমাদের ভাবি রওনক সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু একটা করার। ২০২০ সালের জুন মাসে দ্য প্যাটিস্যারি বাই আহমেদ’স নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করলাম। প্যাটিস্যারি বলতে বেকারি আইটেমকে বোঝায়। পরিকল্পনা ছাড়া একদম শখের বসেই এ ব্যবসা শুরু করলাম। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। তবে ভয় পাচ্ছিলাম বাবাকে। প্রথমে তাকে কিছুই জানাইনি।

তিনজন ১৫ হাজার করে মোট ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করি ব্যবসা। যদিও পরে ব্যস্ততার কারণে ভাবি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেননি। প্রথমে মা একদমই সাপোর্ট দেননি। অনেকবার বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন। মা বলেছিলেন, মানুষ কী বলবে? কিন্তু আব্বু বললেন, ওদের শুরু করতে দাও। অবসর সময়ে কিছু একটা করুক। সময় তো কাটাচ্ছে। অন্তত ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠছে।

এভাবে করোনার অলস সময় কাজে লাগাতে অনলাইনে আমাদের ব্যবসা শুরু। প্রথম কেকের অর্ডার দিয়েছিলেন লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজের (এলসিএলএস) একজন বড় আপু। তিনি আমাদের অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। প্রথমটা ছিল ডল কেক। সেটি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম।

প্যাটিস্যারি বাই আহমেদ’স থেকে তৈরি কেকের বিশেষত্ব নিয়ে দুই বোন বলেন, আমাদের কেকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেশের সব পেস্ট্রি শপ কেক বানাতে যে ক্রিম ব্যবহার করে আমরা সেটা করি না। আমরা মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা বাটার ক্রিম ব্যবহার করি। মালয়েশিয়ান বাটার প্রক্রিয়াজাত করে আমরা সুইস বাটার বানাই। সুইজারল্যান্ডের একটি স্টাইলে আমরা প্রথমে বাটার তৈরি করি। যেটা ইউটিউব থেকে শিখেছি।

কেক তৈরি নিয়ে বিদেশি অনেক আর্টিকেল পড়েছি। আমাদের বানানো কেকের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত একটা ডেজার্ট টিরামিসু। এটা ইটালিয়ান ডেজার্ট। আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি আমাদের ডেজার্টের মতো এত স্বাদের কেউ তৈরি করতে পারবে না। আমরা অনেক নামকরা দোকানের টিরামিসু ট্রাই করেছি, খেয়ে দেখেছি কাদেরটা ভালো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের যেকোনো টিরামিসু ডেজার্টের চেয়ে আমাদেরটা ভালো বলতেই হবে। আমরা কেক বানানোর ১২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা করি। এতে কেকের স্বাদ নষ্ট হয় না।

কেকের দাম এবং কেক বিক্রি করে কত আয় করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সিপ্তি-সুইটি বলেন, আমাদের কাছের মানুষদের সঙ্গে কেকের মূল্য নিয়ে কখনও দামাদামি করি না। কারণ, এটা আমাদের শখের ব্যবসা।

আমরা আড়াই থেকে সাড়ে নয় হাজার টাকা দামের কেক বিক্রি করেছি। রংপুরেও কেক ডেলিভারি দিয়েছি। প্রথম মাসে কেক বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা আয় করেছিলাম। একবার টিরামিসু ডেজার্টের কেক ১০৬ জনকে ডেলিভারি দিয়েছিলাম। সেটা ছিল আমাদের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। কখনও ভাবিনি এত অর্ডার আসবে। সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল।

দুই বোনের সঙ্গে কথা বলছেন ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম

শুরুর দিকে সাড়ে আট হাজার টাকার কেক নষ্ট হওয়ার স্মৃতি তুলে ধরেন এ দুই ক্ষুদে উদ্যোক্তারা। তারা বলেন, প্রথম দিকে আমরা পাঁচ কেজির একটি কেক বানিয়েছিলাম। পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আরেকটা ঘটনা, একজন সাড়ে আট হাজার টাকা দামের কেক অর্ডার দিয়েছিলেন। কেক বানানো শেষে ফ্রিজে রেখেছিলাম, বিকেল ৩টায় ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। ২টার দিকে ফ্রিজ খুলে দেখি কেক গলে হাফ হয়ে গেছে।

ফ্রিজের তাপমাত্রা বেশি দেওয়ার কারণে এমনটা হয়েছিল। এটা দেখে আমরা নির্বাক, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কী জবাব দেব ক্লায়েন্টের কাছে এই ভেবে। সঙ্গে সঙ্গে যিনি অর্ডার দিয়েছিলেন তাকে কল করে ঘটনা খুলে বললাম। তারপরও তিনি নাছোড়বান্দা। বললেন, আপনাদের থেকেই কেক নিব। কতক্ষণ লাগবে সেটা বলেন। তখন দুই বোন আল্লাহর নাম নিয়ে আবার কেক বানানো শুরু করলাম। এটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

নিজেদের ব্যবসা আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন সিপ্তি ও সুইটি আহমেদ। বেকিং ব্যবসা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত দুই বোন বলেন, আমাদের পরবর্তী চিন্তা হচ্ছে গুলশান-বনানীর আশপাশে একটি ডেজার্ট শপ দেওয়া। সুন্দর পরিবেশে একটা আউটলেট থাকবে। সেখানে শুধু কেক নয়, কেক কেটে উৎসব পালনের ব্যবস্থাও থাকবে। শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিকভাবেও আমাদের এই বেকিং ব্যবসা সম্প্রসারণের স্বপ্ন দেখি। দেশের বাইরে দুবাইয়ে শপ দেওয়ার ইচ্ছা আছে।

নিজেদের বাসভবনে সিপ্তি আহমেদ ও সুইটি আহমেদ

বাবা প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী হওয়ার পরও দুই বোনের অনলাইন ব্যবসায় জড়ানো প্রসঙ্গে তারা বলেন, বাবা একদম ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ী হয়েছেন। তিনিও চান তার ছেলে-মেয়েরা স্বনির্ভর হোক। এখন বাবা-মা অনেক সাপোর্ট দেন। আম্মু মানুষকে বলেন, আমার মেয়েরা তো কেক বানায়, তুমি নিতে পার। অনেক মজার।

বেকিং ব্যবসা থেকে আয়ের একটি বড় অংশ নারীশিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করতে চান সিপ্তি ও সুইটি আহমেদ। তাদের ভাষায়, আমাদের সমাজে নারীদের অনেক নীচ ভাবা হয়। ১৮ বছর হয়ে গেলেই বিয়ে দেওয়া হয়। নারীশিক্ষার জন্য আমরা নিজেদের আয়ের ৫০ ভাগও খরচ করতে রাজি। এটা অবশ্যই আমরা করব।

এমএইচডি/এমএইচএস