আশুলিয়ায় বসে ফিশিং লিংকের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের প্রায় ২ হাজার ৫০০ ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছেন মো. লিটন ইসলাম। হ্যাক করা আইডি থেকে গুরুত্বপূর্ণ-স্পর্শকাতর তথ্য, গোপন ছবি এবং ভিডিও হাতিয়ে নিতেন তিনি।

পরে লিটন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাত তাদের আইডি সে হ্যাক করেছে। তার চাহিদা মতো টাকা না দিলে আইডি থেকে নেওয়া গোপন তথ্য, ছবি ও ভিডিও সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিবে এমন হুমকি দিত। তার এই হুমকিতে কেউ কেউ টাকা দিতে রাজি না হলে সে ভুক্তভোগীদের জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত। তাতে অনেক ভুক্তভোগী ভয় পেয়ে লিটনের চাহিদা মতো টাকা দিয়ে দিত।

এমনই এক ভুক্তভোগী ডিএমপির কদমতলী থানায় গত ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক হ্যাকার লিটন ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। সেই মামলাটি ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবির-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। মামলাটি তদন্তকালে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় রোববার (১০ এপ্রিল) সন্ধ্যায় আশুলিয়ার এনায়েতপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে আন্তর্জাতিক হ্যাকার লিটনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে হ্যাকিংয়ের কাজে ব্যবহৃত ১টি সিপিইউ, ২টি মোবাইল ফোন ও ১০টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ডিভাইসে তার দখলে থাকা ২ হাজার ৫০০ দেশি-বিদেশি ফেসবুক আইডির ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড পাওয়া যায়।

অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের লিডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল হক বলেন, যেই ভুক্তভোগীর কাছে যেমন টাকা নেওয়া যায় সেভাবে টাকা নিত লিটন। কারো কাছে কম কারো কাছ থেকে বেশি। সর্বনিম্ব ১০ হাজার টাকা নিতো সে। গোপন তথ্য, ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির পরেও যারা টাকা দিতে রাজি হতো না তাদেরকে জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত। লিটন ভুক্তভোগীদের বলত ‘টাকা না দিলে আপনার আইডি থেকে রাষ্ট্র বিরোধী এমন পোস্ট করা হবে যেন সবাই আপনাকে জঙ্গি মনে করেন।’ এসব হুমকি দেওয়ার পর ভুক্তভোগীরা ভয়ে তাকে টাকা দিয়ে দিত।

কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হ্যাকার প্রশ্ন করা হলে এডিসি মো. নাজমুল হক বলেন, হ্যাকারের কাছ থেকে ১০টি সিম কার্ড পাওয়া গেছে। সেগুলোতে বিকাশ ও রকেট অ্যাকাউন্ট আছে। ওই সব মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্টের স্টেইমেন্ট বিশ্লেষণ করলে টাকা আত্মসাতের পরিমাণ জানা যাবে।

এ দিকে সোমবার (১১ এপ্রিল) মিন্টুরোডে অবস্থিত ডিবি অফিসে নিজ কার্যালয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।

তিনি বলেন, হ্যাকার প্রথমে অনলাইনে ফিশিং লিংক তৈরি করে ছবি ও ভিডিও যুক্ত করে ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে। ওই লিংকে ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইনের চেষ্টা করামাত্রই সেই পাসওয়ার্ড ও ইউজার নেম হ্যাকারের কাছে চলে যায়। পরে হ্যাকার লিটন সেই আইডির পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে দ্রুত তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারপর নিয়ন্ত্রণে নেওয়া আইডির মেসেঞ্জারে থাকা বিভিন্ন ব্যাক্তিগত তথ্য ও ছবি-ভিডিও সংগ্রহ করে ডাউনলোড করে তা সংরক্ষণ করে। মামলাটি তদন্তকালে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় লিটনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, প্রায় আড়াই হাজারের মত ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছে আন্তর্জাতিক হ্যাকার লিটন। যাদের মধ্যে অনেক ভিআইপি ও শিল্পপতিদেরও অ্যাকাউন্ট আছে। শুধু দেশের নয় বিদেশি নাগরিকদের আইডিও সে হ্যাক করেছে।

মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ আরও বলেন, গ্রেপ্তারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, আইডি হ্যাক করে তার মূল উদ্দেশ্য হল চাঁদাবাজি করা। হ্যাক হওয়ার পর ভুক্তভোগীর ফেসবুকে থাকা সব তথ্য সে নিয়ে নিত। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে হ্যাকার দেখত এর মধ্যে নেগেটিভ কোনো তথ্য আছে কি না। নেগেটিভ তথ্য পেয়ে গেলে সে ভুক্তভোগীকে বলত ‘আপনার আইডি আমি হ্যাক করেছি। আমাকে টাকা না দিলে আপনার সব গোপন তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিব।’

ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, গোপন তথ্য ও ছবি ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী তাকে টাকা দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয় আমেরিকা ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের আইডি হ্যাক করে এভাবে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সে। এভাবে অনেক মানুষকে সে সর্বশান্ত করেছে। সে আমাদের কাছে স্বীকার করেছে এভাবে হাজার হাজার মানুষকে প্রতারিত করেছে। তার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত রয়েছে, তাদের বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি।

তিনি বলেন, এটি একটি জঘন্যতম অপরাধ। আমরা মনে করি অনেক মানুষ বিশেষ করে অনেক মেয়েরা এই ধরণের সমস্যায় পড়েছেন। সামাজিকতার ভয়ে তারা এসব তথ্য আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন না। যার কারণে আমরা দেখেছি ওই সুযোগটাই হ্যাকার ও প্রতারকরা নিয়ে থাকে। শুধু মেয়েরা না তাদের খপ্পরে অনেক ভিআইপি ও শিল্পপতিরাও পড়েছেন। এমন ঘটনায় দ্রুত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা দ্রুত এসব হ্যাকারকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব।

এ সময় হ্যাকারদের কাছ থেকে বাঁচতে বেশ কিছু পরামর্শ দেন মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।

পরামর্শ গুলো হল-

১. সাইবার স্পেসে অপরিচিত কোন আইডি থেকে প্রেরিত কোন লিংকে প্রবেশ না করা।

২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরিচিত কোন আইডির সঙ্গে বন্ধুত্ব না করা।

৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথাযথ সিকিউরিটি সেটিংস ব্যবহার করা।

৪. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি-ভিডিও শেয়ার না করা।

গ্রেপ্তার লিটনকে ৭ দিনের পুলিশ রিমান্ডের আবেদনসহ আদালতে পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এমএসি/আইএসএইচ