৪০ বছর ধরে গাড়ি চালাই। দিনের পর দিন এই ঘাটে বসে থাকি, রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি; তীব্র শীতের মধ্যেও অপেক্ষা করি। কখনো ৪/৫ ঘন্টার আগে ঘাট পার হতে পারি না। আজ রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘাটে এসেছি। দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে, এখনো ফেরির সিরিয়াল পাইনি। নিজের বয়সের প্রায় অর্ধেক সময় ঘাটেই কেটে গেছে অপেক্ষায়।

অপেক্ষা। পদ্মা নদীর ওপারের মানুষের কাছে শত বছরের বড় আক্ষেপের নাম কিংবা বড় দুঃখের নাম। এক জীবনে তারা যত অপেক্ষা করেছে পদ্মার দুই তীরে তা হয়তো সময় দিয়ে মাপাও যাবে না। তবে এটা ঠিক, জীবনের অন্য কোনো কাজে কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধনে কিংবা অন্য কোথাও অন্য কোনো পথে তাদের এতটা গুনতে হয়নি অপেক্ষার প্রহর।

কয়েক দিন আগে পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জ প্রান্তের মাওয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায় ফেরির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে শত শত যানবাহন। ঘাটে আছেন পায়ে হাঁটা মানুষ, মোটরসাইকেল আরোহী, ব্যক্তিগত যানের যাত্রী, বাসযাত্রী আর ট্রাকের চালক ও সহকারীরা।

সেখানে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে অপেক্ষায় ছিলেন প্রায় ৭০ বছর বয়সী পিকআপ চালক তোফাজ্জল হোসেনও। তিনি বলেন, এই ঘাটে ৮/১০ ঘন্টা অপেক্ষা যেন স্বাভাবিক ঘটনা। কখনো কখনো ২০ ঘন্টা এমনকি দুদিনও কেটে গেছে ঘাটে।

পদ্মা সেতু চালুর পর আর ভোগান্তি থাকবে না বলে বিশ্বাস করেন তোফাজ্জল- ‘সেতু চালু মানে সবার সুবিধা। নদী পার হওয়ার জন্য বসে থাকতে হবে না। দুই-চারশ’ টাকা লাগুক বেশি, আপত্তি নেই তাতে।’

ঘাটে ফেরি পারাপারে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা আর নানা ভোগান্তির চির অবসান ঘটাবে পদ্মা সেতু- এমন আশায় বয়োজ্যেষ্ঠ তোফাজ্জলের মুখে কিছুক্ষণ লেগে থাকে সুখের হাসি।

নিজের জীবনের দীর্ঘ সময়ের ‘অপেক্ষা’ আর ভোগান্তির কথা জানানোর পাশাপাশি ষাটোর্ধ্ব তোফাজ্জল হোসেন জানান পদ্মা সেতু চালুর জন্য এখন তার তর সইছে না- বলেন, ‘কবে চালু হবে সেতু?’

কেবল তোফাজ্জল হোসেন নয়, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এখন পদ্মা সেতুর গল্প। তাদের মুখে সেতু চালুর অপেক্ষার গল্প আর জয়গান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

শেখ হাসিনার এক সিদ্ধান্তেই পরিবর্তন হচ্ছে কোটি মানুষের ভাগ্য

অপেক্ষা আর ভোগান্তিই ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য। সেখান থেকে শেখ হাসিনার যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্তে ষড়যন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা; বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ীর মতো ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু।

এখন এই সেতু ঘিরেই সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন এই অঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। দিনে দিনে ঢাকায় যাতায়াতের সুবিধা আর ভোগান্তির অবসানের উচ্ছ্বাস এখন এই অঞ্চলের সবার মুখে।

‘সেতু চালু হইতাছে, আলহামদুলিল্লাহ’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার গ্রামের বাড়িতে পরিবার নিয়ে ফিরছিলেন লাবনী আক্তার। মাওয়া ঘাটে তপ্ত রোদে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় তাকে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হইতাছে, আলহামদুলিল্লাহ। ফেরি-লঞ্চের জন্য আর ঘণ্টার পার ঘণ্টা অপেক্ষা করা লাগবে না। এখানে দেখেন, খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ নাই, গরমে বাচ্চাটা অসুস্থা হইয়া পড়ছে। সেই সকাল আটটায় আইছি। এখন বাজে সাড়ে ১২টা। কিন্তু ফেরির খবর নাই।

আব্দুল মোমেন নামে বরিশালগামী এক পিকআপযাত্রী বলেন, সকাল ৯টায় এসেছি। বসে আছি তো আছিই। ফেরিতে ওঠার সুযোগ পাইনি এখনো। সেতুটা চালু হলে সময়ও বাঁইচা যায়, ভোগান্তিও থাকে না। টাকা বেশি লাগলে লাগুক।

পেশায় ১৫ বছর ধরে মোটর যানের চালক মো. হানিফ বলেন, সেই ভোর চারটা থেকে মাওয়া ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছি। সব দেখি ভিআইপি গাড়ি ছাড়ে, আমগো খবর নাই। পেছনে গাড়ির অভাব নাই। কতক্ষণ লাগবে কে জানে!

তিনি বলেন, সেতু চালু হলে গোপালগঞ্জ গিয়া ট্রিপ নামাইয়া নতুন ট্রিপ ধরতে পারমু। ভাড়া বেশি লাগলেও সময় অনেক বাঁচবে। ট্রিপ বেশি মারতে পারমু, কষ্টও আর থাকব না।

‘এক বাসেই ঢাকা যাইতে পারমু’

গোপালগঞ্জগামী এক যাত্রী জানান, ৪/৫টা গাড়ি পাল্টিয়ে তবে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে হয়। তিনি বলেন, বাসে করে টেকেরহাটে আসি, সেখানে বাস পাল্টাই। এরপর লঞ্চে উঠি, ঘাটে নেমে আবার বাসে উঠি। এরপর ঢাকায় পৌঁছাই।

তিনি বলেন, এখন সেতু চালু হইলে এক বাসেই ঢাকায় যাইতে পারমু। দিনে দিনে যাওয়া-আসা করা যাবে, ভাবতেই ভালো লাগছে। খরচ বাড়লেও সরকার সেটা দেখুক। মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধাটাও দেখতে হবে।

 উচ্ছ্বসিত বাসমালিকরা

সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যাতায়াতকারী এমআর পরিবহনের মালিক নুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাতক্ষীরা থেকে আমাদের জেলার অধিকাংশ বাসই চলাচল করে আরিচা ঘাট হয়ে। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে আমরা এর সুবিধা পাব। এখন ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা। ফেরির টোল দিতে হয় দুই হাজার টাকা। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলে সময় বাঁচবে কমপক্ষে ৪ ঘন্টা। মাত্র ৬ ঘন্টায় আমরা ঢাকায় পৌঁছে যাব। বড় বাস হিসেবে পদ্মার টোলসহ অন্যান্য টোল দিতে হবে বেশি। কিন্তু ঘাটে ঘাটে অপেক্ষার যে ভোগান্তি সেটা আর থাকবে না। মানুষও উপকৃত হবে।

বাগেরহাট বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তালুকদার আব্দুল বাকি বলেন, পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে রাজধানীর সঙ্গে বাগেরহাটবাসীর যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধির পাশাপাশি জেলার মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নও ঘটবে।

তিনি বলেন, এখন বাগেরহাটের মানুষের ঢাকা যেতে হলে ফেরি, স্পিড বোট বা লঞ্চে পদ্মা নদী পার হতে হয়। এর ফলে ঢাকা যাতায়াতে অনেক বেশি সময় লাগে। খুলনা-বরিশাল ছাড়া দেশের বেশিরভাগ বড় শহরে যেতে পদ্মানদী পার হতে হয়। পদ্মা পার হওয়ার সময় ঘাটে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় যাত্রীদের। সেতু চালু হলে এই বিড়ম্বনার হাত থেকে যাত্রীরা যেমন বাঁচবে, তেমনি সময়ও বাঁচবে। সেই সাথে পরিবহন সেক্টরে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়বে কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ।

ভাড়া ‘ফ্যাক্টর’ নয় : মালিক সমিতি

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। এখনো এই রুটের কোনো বাসের ভাড়া নির্ধারণ করতে পারিনি। টোল খরচসহ মূল ভাড়া সমন্বয় করা হবে। বিআরটিএ’র সঙ্গে এ নিয়ে সমন্বয় সভা হবে। সেখানে রুট ও দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারিত হবে।

তিনি বলেন, তবে আমরা বিশ্বাস করি, সড়ক পথের ব্যবহার বাড়বে, পদ্মা সেতুর সুবিধা সবার আগে এই অঞ্চলের মানুষ পাবে। এতে ভাড়া কিছুটা বাড়লেও সমস্যা হবে না।

জেইউ/জেএস/ওএফ