পর্ব-১

দারিদ্র্যকে জয় করার স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে আসেন অনেকে। ভাগ্য বদলের আশায় ঘাম বেচে টাকা রোজগারের আশায় এসব রেমিট্যান্স যোদ্ধারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়ে দেন প্রবাসে। এই প্রবাস জীবনের অনেক কিছুই অজানা থেকে যায় তাদের স্বজনদের কাছে। প্রবাসে প্রতিটি শ্রমিকই তাদের এ দুঃখ-কষ্টের কথা পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে আড়াল করতে চায়।  শ্রমে ভেজা অনেক গল্প আড়ালেই রয়ে যায়।

এক সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ছিল বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। কিন্তু এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দুবাইয়ে শ্রমিকরা কাজ করছে। সীমাবদ্ধতার মাত্রাটা এমন যে কেউ যদি মারা যায় তার মরদেহটাও দেশে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না অনেক সময়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সবার পর হয়ে যায় সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসী। কেউ চেনে না তখন তাকে। বাধ্য হয়ে পরকালের জীবনটাও তাদের কাটিয়ে দিতে হয় প্রবাসেই। ‘কোনমতে মাটিচাপা দেওয়া’ সেসব দুর্ভাগা প্রবাসীদের কবরটাও থাকে নিদারুণ অবহেলায়। একটি পাথরে থাকে কেবলই তাদের নাম। অনেকের ভাগ্যে তাও জোটে না। দাফন হয় বেওয়ারিশ হিসেবে।

দুবাই শহরে প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল মারা যাওয়া এসব ‘বেওয়ারিশ’ প্রবাসীদের দুবাইয়ের আল কুসাইস সিমেট্রিতে (কবরস্থান) দাফন করা হয়েছে। সেই কবরস্থানে গিয়ে চোখে পড়লো সত্যিই তাই।

জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে ভিন দেশে পাড়ি দেওয়া বহু প্রবাসী বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছেন সেখানেই/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

এ কবরস্থানটি দুবাইয়ের মূলশহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। গাড়ি নিয়ে কবরস্থানটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি কবর। দুবাই প্রবাসী ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের কবর। তবে অধিকাংশ কবরই বাংলাদেশিদের।

প্রবাসীরা জানান, এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা মারা গেলে তাদের পরিবার অথবা দেশটির সরকার বা এনজিও মরদেহ বহন করে দেশে পৌঁছে দেয়। তবে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। প্রবাসী যদি গরীব হয়, তাহলে তার মরদেহের ঠাঁই হয় এই কবরস্থানে। সরকার কিংবা কোনো সংগঠনই মরদেহ বহনে রাজি হয় না।

কবরস্থানে গিয়ে চোখে পড়লো একজন বাংলাদেশিকে কবর দেওয়ার দৃশ্য। পাশে অসংখ্য বাংলাদেশির কবর। সেসব কবরের চিহ্ন বলতে একটি পাথর। সেই পাথরে রং দিয়ে প্রবাসীর নাম লেখা, অনেকক্ষেত্রে ইউএই রেসিডেন্ট আইডিও লেখা থাকে। জিয়ারত করা দূরের কথা হাতেগোনা দু-একজন বাংলাদেশি ছাড়া কেউ দেখতেও যায় না সেই কবর।

পরিবারকে সচ্ছল করার সংকল্প নিয়ে প্রবাসে আসা প্রবাসীর যে মরণকালে এমন দৈন্যদশা হবে কেইবা ভেবেছিল?

আশপাশের বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবছরের ৪ জানুয়ারি আবেদ নামে এক যুবক মোবাইল হ্যান্ডসেট দোকানে ডিউটি করার সময় হঠাৎই ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যায়। আবেদের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা। পরিবারের আহাজারি সত্ত্বেও আবেদকে শায়িত হতে হয়েছে দুবাইয়ের মাটিতেই।

কারণ আবেদের বাংলাদেশ পর্যন্ত বহন করতে খরচ হবে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। অথচ আবেদ চাকরি করে মাসে আয় করতো মাত্র ৩১ হাজার টাকা। তার মতো প্রতিদিনই দুবাইয়ের কোনো না কোনো এলাকায় মৃত বাংলাদেশিদের মরদেহ দুবাইয়ের বিভিন্ন কবরস্থানেই দাফন করা হচ্ছে। তবে যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধা দিনরাত পরিশ্রম করে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে তাদের মরদেহ নিয়েই অবহেলা হয় নিয়মিত।

সোনাপুর লেবার ক্যাম্পের প্রবাসীরা জানান, এখানে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রবাসীরা থাকে। এখানকার কেউ মারা গেলে পরিবারের বা সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ মরদেহই নিতে আসে না। এসব মরদেহ স্থানীয় মেডিকেলে ১০-১২ দিন ফ্রিজে থাকে। এরপর এগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়। অনেকটা অবহেলায় তাদের এই কবরস্থানে দাফন করা হয়। অনেকসময় তারা কবরে চিহ্ন দেয় না। মৃত্যুবরণকারীর সহকর্মীরা মার্কার দিয়ে নিজ দায়িত্বে নাম লিখে দিয়ে আসে।

দুবাইয়ের আল কুসাইস সিমেট্রি (কবরস্থান) 

প্রবাসীদের অবহেলার বিষয়ে দুবাইয়ের ডেরার প্রবাসী চট্টগ্রামের মো. জালাল বলেন, সব দেশের সরকার নিজ দায়িত্বে প্রবাসীদের মরদেহ নিয়ে যায়। একমাত্র বাংলাদেশ সরকার খবর নেয় না। দুবাইয়ের বিধান অনুযায়ী যে কোনো প্রবাসী মারা গেলে তার ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য সময় লাগে ১০-১২ দিন। এই কয়দিন মরদেহ ফেলে রাখা হয় স্থানীয় হাসপাতালের ফ্রিজে। তারা ইচ্ছেমতো সময়ে সেগুলোর ময়নাতদন্ত করে। ময়নাতদন্তের পর কেউ মরদেহ না নিলে আল কুসাইস সিমেট্রিতে দাফন করা হয়। এর জন্যও টাকা লাগে।

তিনি আরও বলেন, আমার একটাই অনুরোধ, আমরা যারা প্রবাসে থাকি, আমাদের পরিবারের লোকজন আমাদের দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আমরা মারা গেলে যাতে অন্তত টাকার অভাবে আমাদের মরদেহ এখানে আটকে না থাকে, যাতে আমার পরিবার অন্তত লাশটুকু দেখতে পারে, সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে বিশেষ অনুরোধ করছি।

দীর্ঘদিন ধরেই প্রবাসে বাংলাদেশি মারা গেলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিনা ভাড়ায় সেই মরদেহ পরিবহন করে দেশে নিয়ে আসতো। প্রতিবছর গড়ে কেবল সৌদি আরব, আবুধাবি ও দুবাই থেকে প্রায় ৭৫০ থেকে ৯০০ জন প্রবাসীর মরদেহ নিয়ে আসে তারা। তবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ‘সম্পূর্ণ বিনামূল্যে’ মরদেহ আনায় আপত্তি জানিয়েছে বিমান এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। ২০২০ সাল থেকে বন্ধ হয়ে যায় বিনামূল্যে মরদেহ পরিবহন। এরপর থেকে নিজ খরচেই বাংলাদেশে আসে প্রবাসীদের মরদেহ।

তবে দুই-আড়াই লাখ খরচ করে দীর্ঘ কয়েকমাস ধরে দুবাই থেকে আর আসছে না মরদেহ। দুবাইতেই কবর দেওয়া হচ্ছে তাদের।

মরদেহ বহনকারী এমিরেটস, তার্কিশ এয়ারলাইন্স ও এয়ার এরাবিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে একজন ব্যক্তির মরদেহের কফিন বহনের জন্য প্রতি কেজি ১৮ ডলার বা বাংলাদেশি ১৫৩০ টাকার নেয়।

এবিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তারা কতদিন এভাবে বিনামূল্যে মরদেহ বহন করবে। তাদের অন্তত ন্যূনতম খরচটাতো পেতে হবে। তবে প্রবাসীরা যখন দেশের বাইরে যায় তখন তারা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ ফান্ডে টাকা জমা দিয়ে যায়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় চাইলেই সেই ফান্ড থেকে বিমানকে মরদেহ বহনের টাকা পরিশোধ করে দিতে পারে। এবিষয়ে বিমানের পক্ষ থেকে তাদের চিঠি দেওয়া হলেও মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।’

এবিষয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বলছে, ২০২০ সালে তারা ২৮৮৪ জনের মরদেহের খরচ বহন করেছে। তবে এই বছর বিদেশে মোট কতজন মারা গেছে সেবিষয়ে তারা কোনো তথ্য দেয়নি।

এআর/এসএম