পিকআপভ্যান চালক রিপন আহমেদ। প্রায় ছয় বছর ধরে মালবাহী গাড়ি চালান তিনি। আগে অবশ্য চালাতেন বড় ট্রাক। মালামালের ট্রিপ নিয়ে রাজধানী ঢাকায় যাবেন বলে যখন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ছাত্তার মাদবর ফেরিঘাটের সিরিয়ালে দাঁড়িয়েছেন তখন সময় রাত ৩টা। ভোর পেরিয়ে সকাল হয়েছে, সকাল গড়িয়ে দুপুর; তবুও তিনি ফেরিতে উঠতে পারেননি। ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে ১১ ঘণ্টা।

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নে পদ্মার তীরে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে তখন কয়েকশ যানবাহনের অপেক্ষা। এই অপেক্ষা ছাত্তার মাদবর ঘাট থেকে ফেরিতে করে নদী পার হয়ে মাওয়া ঘাটে পৌঁছানোর।

ঘড়ির কাঁটা দুপুর ২টা সবে পেরিয়েছে, এমন সময় কথা হয় পিকআপভ্যানের চালক রিপন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত ৩টায় সিরিয়ালে দাঁড়িয়েছি। কিছুক্ষণ পরপর একটু একটু করে গাড়ি ছাড়ে। গাড়ি রেখে খেতে যাওয়ারও সুযোগ পাইনি। কারণ একটু পরপর দুই/চার হাত করে গাড়ি ছাড়ছে।

না খেয়ে, না ঘুমিয়ে এমন অপেক্ষা পদ্মার এ পাড়ের মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে আছে বছরের পর বছর। রিপনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখনো তার ফেরিতে উঠতে আরও এক ঘণ্টা সময় লাগার কথা। এরপর ফেরিতে উঠে নদী পার হতে লাগবে এক ঘণ্টা। মাওয়া থেকে ঢাকায় যেতে লাগবে আরও ঘণ্টাখানেক। এভাবে তার ১৪/১৫ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে ঢাকায় পৌঁছাতে।

রিপন বলেন, আমাদের এই দুঃখ-কষ্ট আর কদিন পরে থাকবে না। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে এসব ভোগান্তি ছাড়া মাত্র দেড় ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছে যাব। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়; সবচেয়ে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের বিষয়। এখন আমাদের খুশিই সবচেয়ে বেশি.... পদ্মা সেতু ছুঁয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টায় ঢাকায় যেতে পারব আমরা।

সারাজীবনের ভোগান্তির অবসান হতে যাওয়ায় এই উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর আবেগ শরীয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সব মানুষের। তাই এই পদ্মা সেতু শুধু রড-সিমেন্ট, পাথর-কংক্রিটের সেতু নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এসব মানুষের বহু বছরের আবেগ-অনুভূতি। আর মাত্র কয়েকদিন, এখন কেবল সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। আগামী ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এতদিন যাতায়াতকারীদের ফেরি, লঞ্চ, স্পিড বোটের জন্য অপেক্ষার চিত্র ছিল নিয়মিত। সেই সঙ্গে নানা সময় বৈরী পরিস্থিতিতে ঘাটে এসে দুর্ভোগে পড়তে হতো তাদের। শুধু তাই নয় দুর্ঘটনায় প্রাণও হারাতে হয়েছে অনেককে। কয়েকদিন পর থেকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না আর। তাই তাদের উচ্ছ্বাসটা অন্যদের চেয়ে বেশি, তাদের এখন শুধু অপেক্ষা স্বপ্ন ছোঁয়ার।

জাজিরার নাওডোবা ইউনিয়নের বাসিন্দা মতি জমাদ্দার পেশায় অটোরিকশা চালক। পাশাপাশি কাঁচা পণ্যের ব্যবসাও করেন। জাজিরার পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট সংলগ্ন গোলচত্বরে যাত্রী নিয়ে এসেছেন তিনি। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে।

এই অটোরিকশা চালক বলেন, লঞ্চ, স্পিড বোট, নৌকা, ফেরি ছাড়া জীবনেও কোনোদিন আমরা জেলার বাইরে যেতে পারিনি। ঢাকা যেতে পদ্মা নদী পার হওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু এখন পদ্মা সেতু হয়েছে। কয়েকদিন পর মাত্র ৮ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে এই সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পেরিয়ে যেতে পারব। এখান থেকে এক ঘণ্টায় ঢাকা যাব কাঁচা মালামাল নিয়ে। এই পদ্মা সেতু আমাদের এলাকার মানুষের সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল।

আরেকটু এগিয়ে যেতে দেখা গেল পদ্মা সেতু দেখিয়ে পাশের একজনের সঙ্গে আলাপ করছেন সরুজ মিয়া। তিনি স্থানীয় পাট ব্যবসায়ী। আলাপ হয় তার সঙ্গে। সরুজ মিয়া বলেন, আমরা যারা পদ্মার এ পাড়ে বাস করি তাদের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। কোনো প্রয়োজনে কোথাও যেতে হলে পদ্মা পার হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। বৈরি আবহাওয়া থাকলে আমাদের যাওয়াও বন্ধ থাকত। এসব ভোগান্তির দিন শেষ করে সেতু দিয়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার দিন আসছে আমাদের। এখন যখন ইচ্ছে তখন মাত্র এক ঘণ্টায় ঢাকা চলে যেতে পারব। ঢাকায় কাজ সেরে দুপুরে বাড়িতে এসে ভাত খাব। শুধু আমরা শরীয়তপুরবাসী নয়, ২১ জেলার মানুষের ভোগান্তি দূর হচ্ছে এই পদ্মা সেতুর মাধ্যমে।

শরীয়তপুরের পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে সরগরম এখন পুরো এলাকা। রাত ৯টার পরও জমজমাট মাঝির ঘাটের দবির মল্লিকের চায়ের দোকান। আসন্ন নির্বাচনের চেয়ে চায়ের দোকানে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়েই এলাকাবাসীর মধ্যে আলোচনা বেশি।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কথা হয় এই এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। তার এক ছেলে ঢাকায় একটি কলেজে পড়েন, আরেক ছেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

আলাপকালে তিনি বলেন, সারাজীবন খুব কষ্ট করে আমরা যাতায়াত করেছি। কিন্তু কয়েকদিন পর আমাদের চেয়ে যাতায়াতে সুখী আর কেউ হবে না। আমার ছেলেরা ইচ্ছে করলে বাড়ি থেকে গিয়ে ঢাকার কলেজে ক্লাস করতে পারবে, অফিস করে রাতে বাসায় এসে ঘুমাতে পারবে। আর পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে আমাদের এখানে যে পরিমাণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে তাতে এখানেই এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে যাবে।

ফরহাদ হোসেন একটি প্রাইভেট কারের চালক। তার গাড়ির মালিক ঢাকার উত্তরার একজন ব্যবসায়ী। তার মূল বাড়ি শরীয়তপুর সদরে। বাড়ি এখানে হওয়ার কারণে প্রতি মাসেই ড্রাইভার ফরহাদ হোসেনকে গাড়ি নিয়ে শরীয়তপুরে আসতে হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আজও প্রাইভেটকার নিয়ে জাজিরার অংশের ঘাটে অপেক্ষা করছেন প্রায় চার ঘণ্টা ধরে। তার সামনে পেছনেও তখন গাড়ির দীর্ঘ সারি।

ফরহাদ হোসেন বলেন, এ পাড় থেকে মাওয়া যাওয়ার জন্য ফেরিতে করে নদী পার হতে ১৭ ঘণ্টা অপেক্ষা করার রেকর্ডও আমার আছে। এমনও হয়েছে ফেরিতে ওঠার জন্য সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে সেহেরি খেয়েছি গাড়িতে, ইফতারিও করেছি গাড়িতেই! তবুও ফেরিতে উঠতে পারিনি। এসব ভোগান্তি যারা নিয়মিত ফেস করে, তাদের আনন্দই সবচেয়ে বেশি পদ্মা সেতু চালু হওয়ার খবরে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। আর মাত্র কয়েকটা দিন, এরপর পদ্মা পার হব মাত্র ৫-১০ মিনিটে।

রাজধানীর কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম। নিজে ছাত্র হলেও এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নেন। রাতে সেই স্কুলের পাশেই দবির মল্লিকের চায়ের দোকানে কথা হয় আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ঢাকায় একটি মেসে থাকি। নদী পার হওয়ার সময় ভোগান্তি আমাদের নিত্যসঙ্গী ছিল। যখন ইচ্ছে ঢাকা থেকে বাড়ি আসা বা ঢাকায় যাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। এখন এক ঘণ্টায় ঢাকায় যাব, ক্লাস করব; পরে বিকেলে আবার বাড়ি আসব। ঢাকার মেস ছেড়ে দিয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে শুরু হবে আমাদের যাতায়াত। আমার কৃষক বাবার খরচ কমে যাবে অনেকটাই। মাত্র ১০ মিনিটে পদ্মা সেতু পেরিয়ে এক ঘণ্টায় ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা করতে পারব.... এই আবেগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ ভাষায় বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।

উন্নয়নের দিক থেকে এক সময় অনেক পিছিয়ে থাকা অবহেলিত শরীয়তপুরবাসী পদ্মা সেতুর কল্যাণে আজ স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায়। পদ্মার পাড়েন এবার গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা, হাসপাতাল, গার্মেন্টস, বিশ্বমানের রেস্টুরেন্ট, বিলাসবহুল রিসোর্ট, হোটেল, মোটেলসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো এই এলাকায় বিনিয়োগ করছে। নতুন, পুরোনো ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারাও এই এলাকায় স্বপ্ন বুনছেন পদ্মা সেতুকে ঘিরে। সেই সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।

শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত ঘুরে এসে মাওয়া অংশে ফেরার সময় ফেরিতে দেখা হলো এক বয়স্ক ভিক্ষুকের সঙ্গে। তার নাম রহিমা খাতুন। তিনি নিঃস্ব হওয়ার পর থেকেই অনেক বছর ধরে ফেরিতে নিয়মিত ভিক্ষা করেন। এতেই তার সংসার চলে। পদ্মা সেতু চালু হলে ফেরিতে মানুষ ও যানবাহনের ভিড় আর থাকবে না। তখন তার ভিক্ষাবৃত্তির ওপর প্রভাব পড়বে।

তবে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই রহিমা খাতুনের। তিনি বলেন, তখন অন্য কোথাও গিয়ে ভিক্ষা করব, তাও পদ্মা সেতু তাড়াতাড়ি চালু হোক। পদ্মা পার হতে সবারই খুব কষ্ট হয়, অনেক সময় লেগে যায়। সেতু হলে মানুষের কষ্ট দূর হবে, প্রয়োজনে আমি অন্য কোথাও গিয়ে ভিক্ষা করব।

পদ্মা সেতুর চালু হওয়াকে কেন্দ্র করে মানুষের উচ্ছ্বাসের বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদারের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, উন্নয়নের দিক থেকে আগে থেকেই পিছিয়ে থাকা এই জেলাটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। সে কারণে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে গড়ে উঠতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের মানুষের নৌপথে পদ্মা পার হওয়ার দুর্বিষহ ভোগান্তির অবসান ঘটতে যাচ্ছে। এত দিন সুবিধা, উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে ছিল এসব মানুষ। তারা এখন পদ্মা সেতুর সুফল ভোগের অপেক্ষায়। সব মিলিয়ে আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত, খুশিতে আপ্লুত এই এলাকার প্রতিটি মানুষ। এখন শুধু তাদের কয়েকদিনের অপেক্ষা। এরপর থেকে যাতায়াত ব্যবস্থাসহ সার্বিক বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে আলাপ হয় জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান সোহেলের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষ যেমন উচ্ছ্বসিত, তেমনি এলাকায় স্থাপিত হতে যাচ্ছে বাণিজ্যিক সব শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল কারখানা। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এই এলাকার মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সুফল ভোগ করতে এখন শুধু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। সবার মধ্যে আলাদা উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতু শুধু একটি স্ট্রাকচার নয়, এটি একটি স্বপ্নের নাম। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এই এলাকার জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। এখানে গড়ে উঠবে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান; সেই সঙ্গে এগ্রোবেইচড ইকোনমিক জোন করার চেষ্টা আমরা করছি। বেসরকারিভাবে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সুফল ইতোমধ্যে এলাকাবাসী পেতে শুরু করেছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অপেক্ষায় এখন সবাই, সবার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ বিরাজ করছে।

এএসএস/এআর/এসএসএইচ/জেএস