বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. বজলুর রহমান মিয়া বলেছেন, সারা দেশে শিক্ষক নির্যাতনের মহড়া চলছে। শিক্ষক হত্যা ও শিক্ষক নির্যাতন এখন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মান পুনরুদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং শতভাগ উৎসব ভাতাসহ মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি না মানলে সারা দেশের বিক্ষুব্ধ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা ঢাকায় মহাসমাবেশসহ কঠোর থেকে কঠোরতর কর্মসূচি পালনে বাধ্য হবেন।

শনিবার (২ জুলাই) বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি আয়োজিত শিক্ষক হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদানসহ মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে তিনি এসব কথা বলেন।

মো. বজলুর রহমান মিয়া বলেন, শিক্ষক হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা না গেলে জাতিকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। শিক্ষক হত্যা ও নির্যাতনকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুন। পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ, ঈদুল আজহার আগে পূর্ণাঙ্গ বোনাসসহ শিক্ষকদের অধিকার বিষয়ক ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করছি।

মানববন্ধনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী টাকা পাওয়ার আগে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন। কল্যাণ ট্রাস্টে অমানবিকভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করা হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কোনো বদলি এবং পদোন্নতির সুবিধা নেই। একই কারিকুলামের অধীন একই সিলেবাস, একই একাডেমিক সময়সূচি, একইভাবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজে নিয়োজিত থেকেও আর্থিক সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী ও বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে পাহাড়সম বৈষম্য রয়েছে।

চাকরির বয়স ও শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়স ৬৫ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের চাকরির বয়স আগের মতোই রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি গভর্নিং বডির সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ না করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানা সমস্যা বিরাজ করছে। শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন এবং শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আনুপাতিক হারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পদায়ন করা প্রয়োজন।

শিক্ষক হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে তারা বলেন, ঢাকার সাভারে শিক্ষক হত্যা, নড়াইলে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মেরুদণ্ড ও জাতি গঠনের স্থপতি শিক্ষকদের আহত, নিহত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত করার জন্য তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাসহ শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মান পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলো—

১. মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করা।

২. আসন্ন ঈদুল আজহার আগেই সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মতো পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা প্রদান।

৩. পূর্ণাঙ্গ পেনশন প্রথা চালু করা এবং পেনশন প্রথা চালু না হওয়া পর্যন্ত অবসর গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের পাওনা প্রদান এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন বন্ধ করা।

৪. স্বীকৃতি প্রাপ্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা।

৫. সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক’ এর বেতন স্কেল যথাক্রমে ৬ষ্ঠ ও ৭ম গ্রেডে প্রদান।

৬. এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি প্রথা চালু করা।

৭. শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছরে উন্নীত করা।

৮. পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন এবং শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আনুপাতিক হারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পদায়ন।

৯. করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক প্রণোদনা এবং শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষা সহায়ক ডিভাইস প্রদান।

১০. ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সদস্যদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ।

১১. শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান সরকারি ও বেসরকারি সব বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে শিক্ষানীতি-২০১০ দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন উপদেষ্টা মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য বাবু রঞ্জিত কুমার সাহা, সিনিয়র সহ সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আবুল কাশেম, সহ সভাপতি আলী আসগর হাওলাদার ও বেগম নূরুন্নাহার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবু জামিল মো. সেলিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন, অর্থ সম্পাদক মোস্তফা জামান খান, দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, সহ মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শাহানা বেগম, সহ দপ্তর সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় সদস্য প্রবীর রঞ্জন দাস, আজম আলী খানসহ প্রমুখ।

আইবি/এসএসএইচ