মেডিকেলের সব পাঠ্যপুস্তক ইংরেজিতে, নেই বাংলার ছিটেফোঁটাও

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি…’ একুশের প্রথম প্রহর থেকে কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে এ গান। কারণ একটাই, ১৯৫২ সালে ও এর পরবর্তী সময়ে মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়ে বিরল ইতিহাস গড়েছে বাঙালি। আজকের মতো প্রতিবছরই উৎসবমুখর পরিবেশে ভাষার বিশেষ দিনটি পালিত হলেও দেশের বেশ কিছু জায়গায় এখনও উপেক্ষিত বাংলা, যার অন্যতম নজির মেডিকেল শিক্ষা ক্ষেত্রে। চিকিৎসক তৈরির সূতিকাগার মেডিকেল কলেজগুলোতে মাতৃভাষার চর্চা নেই ১০০ ভাগের এক ভাগও।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মূল কথা ছিল- জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার। সে জন্য দাবি ছিল- বাংলা ভাষাকে সর্বত্র প্রচলনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এর কার্যকারিতা স্থগিত রাখা হলো ২০ বছরের জন্য। এরপরে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় নতুন করে বাঙালিয়ানার জোয়ার আসে। তখন বাংলা ভাষায় সব কিছু করার প্রস্তুতি শুরু হয়। এর একটা বড় দিক ছিল শিক্ষার উচ্চতর স্তরের জন্য বাংলায় বই লেখার উদ্যোগ। দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।

এদিকে, ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছরেও অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও উচ্চ শিক্ষাতে ইংরেজির দাপটে বাংলা ভাষার অসহায়ত্ব দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক। তিনি ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তাহলে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং উচ্চ আদালতসহ জাতীয় জীবনের সর্বত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এটার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। এটা দুঃখজনক।’

মাধ্যমিক ও দ্বাদশ শ্রেণি আর সচিবালয়ে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার ব্যবহার, এ অর্জনের মধ্যেই আমাদের একুশের এত বড় আন্দোলনের অর্জন সীমাবদ্ধ থেকে গেল।

আহমদ রফিক, ভাষাসৈনিক

তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিক ও দ্বাদশ শ্রেণি আর সচিবালয়ে ইংরেজির সঙ্গে বাংলার ব্যবহার, এ অর্জনের মধ্যেই আমাদের একুশের এত বড় আন্দোলনের অর্জন সীমাবদ্ধ থেকে গেল। এই যে এত বড় একটি স্লোগান- সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষা চালু কর, এটা আর কেউ হিসেবের মধ্যে আনল না।’

নিজ ভাষায় শিখলে বাস্তব জ্ঞানটা বেশি হয় : এবিএম আবদুল্লাহ

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা শুধু বাংলা ভাষার কথা বলি। শুধুমাত্র এ দিনটিতেই বাংলায় কথাবার্তা, অনুষ্ঠান, শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেওয়া, বাকি ১১ মাস ভাষার কথা মনেই থাকে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভাষার প্রতি তখনই সম্মান দেখানো হবে, যখন আমরা দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারব। এক্ষেত্রে অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, হাটে-বাজারে সর্বস্তরে বাংলা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এটা চালু করা উচিত।’

দেশে মেডিকেল শিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষায় বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। তা হলো- এখন পর্যন্ত মেডিকেলের যত লেখালেখি, টেক্সট বইসহ হাতে কলমে যেগুলো শিক্ষার আছে, সেগুলোর সব ইংরেজিতেই লেখা। এগুলোকে বাংলা ভাষায় করা খুবই কঠিন ব্যাপার এটা সত্য। তবে, সরকারিভাবে যদি উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে মনে হয় সম্ভব।’

এ দিনটিতেই বাংলায় কথাবার্তা, অনুষ্ঠান, শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেওয়া, বাকি ১১ মাস ভাষার কথা মনেই থাকে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভাষার প্রতি তখনই সম্মান দেখানো হবে, যখন আমরা দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারব।

এবিএম আবদুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

তিনি বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষার ভাষাটা শুধু নিজেদের দেশেই পরিবর্তন করলে হবে না, আন্তর্জাতিক নানা মেডিকেল প্রতিষ্ঠান, নানা দেশের সঙ্গে মিলেই এটা পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, আমাদের তো শুধু ভাষার দিকটা দেখলেই হবে না। আন্তর্জাতিক অন্যান্য দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞান, মেডিকেল কলেজ, তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কিন্তু আমাদের চলতে হবে।’

সুবিধা প্রসঙ্গে ইউজিসির এ অধ্যাপক বলেন, ‘যদিও শুরুতে জিনিসটা খুবই কঠিন মনে হয়, তবে চেষ্টা তদবির চালিয়ে যেতে হবে। আর যদি বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো আমাদের বাস্তব জ্ঞান আরেকটু বেশি হবে। কারণ অনেক সময় শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, শিক্ষকরাও অনেক মেডিকেল টার্ম বুঝে উঠতে পারেণ না। ফলে অনেক রোগ সম্পর্কে তারা সঠিকটা বুঝতে না পেরে উল্টো বা ভুল বুঝে থাকেন। এ জন্য নিজ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থাটা যদি করা যায়, আর সেই চর্চাটা আমাদের মধ্যে চালু হয়ে গেলে বিভিন্ন দিক থেকেই আমাদের সুবিধা আসবে। কিন্তু বাইরের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করেই কিন্তু এটা আমাদের করতে হবে।’

বাংলা বই থাকলে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হয় : ডা. আজিজুল হক

বাংলা ভাষায় প্রথম মেডিসিন রেফারেন্স বই লিখেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক (আবদুল্লাহ)। দীর্ঘ চার বছরের চেষ্টায় বাংলা ভাষায় মেডিসিন রেফারেন্স বইটি লেখা শেষ করেন তিনি।

অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে এই ভাষা পড়া, বোঝা ও লেখা অত্যন্ত কঠিন। অনেক সময় অনেক রোগ সম্পর্কে বুঝতে না পেরে ছাত্র-ছাত্রীরা ওই সম্পর্কে বর্ণিত পাঠের উল্টো বা ভুল বুঝে থাকে। এভাবে বিদেশি ভাষায় মেডিসিন চর্চা করতে গিয়ে রোগ বালাই, এর লক্ষণাদি ও চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবে ওই ছাত্র ভবিষ্যতে ভালো চিকিৎসক হতে পারে না।

ডা. আজিজুল হক, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, রামেক

ঢাকা পোস্ট-কে তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যতই ইংরেজিতে জিপিএ-৫ অর্জন করুক না কেন- ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার তাদের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কাজেই অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে এই ভাষা পড়া, বোঝা ও লেখা অত্যন্ত কঠিন। অনেক সময় অনেক রোগ সম্পর্কে বুঝতে না পেরে ছাত্র-ছাত্রীরা ওই সম্পর্কে বর্ণিত পাঠের উল্টো বা ভুল বুঝে থাকে। এভাবে বিদেশি ভাষায় মেডিসিন চর্চা করতে গিয়ে রোগ বালাই, এর লক্ষণাদি ও চিকিৎসা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাবে ওই ছাত্র ভবিষ্যতে ভালো চিকিৎসক হতে পারে না। কাজেই ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি যদি কোনো বাংলা ভাষায় সহায়ক পুস্তক হিসেবে থাকে তবে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ বুঝতে খুবই সুবিধা হবে। এই আশাবাদ নিয়ে মেডিসিনের বাংলা বই লেখার কাজ শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘যদি ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি কোনো একটা বিষয়ে বাংলা ভাষারও একটা বই থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হবে। আমি যা পড়ছি, সেটা যদি ভালো করে বুঝতে না পারি, তাহলে আমি কেমন করে ভালো ডাক্তার হব? কেমন করে রোগীর কাছাকাছি যাব? আর কীভাবেই রোগীর রোগ বা রোগের উপসর্গ বুঝব? এসব বিষয় মাথায় নিয়েই বইটা লিখেছি।’

দেশের প্রখ্যাত এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমি মেডিসিনের দুটি বাংলা বই লিখেছি। তবে এর মধ্যে কিছু টার্ম ইংরেজিতে আছে, যেগুলো আসলে বাংলা করা সম্ভব না। তবে সেক্ষেত্রে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও কিছু বিষয় তুলে ধরেছি। আমরা যদি এই টার্মগুলো থেকে পুরোপুরি বাংলায় যেতে চাই, তাহলে আরও ২০ বছর লাগবে।’

শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয় শিক্ষকরাও অনেক মেডিকেল টার্ম বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে অনেক রোগ সম্পর্কে তারা সঠিকটা বুঝতে না পেরে উল্টো বা ভুল বুঝে থাকেন। এ জন্য নিজ ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থাটা যদি করা যায়, আর সেই চর্চাটা আমাদের মধ্যে চালু হয়ে গেলে বিভিন্ন দিক থেকেই আমাদের সুবিধা আসবে।

এবিএম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক, ইউজিসি

মেডিকেল শিক্ষায় পুরোপুরি বাংলায় যেতে পারি কি-না, জবাবে এ চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা চাইলেই যেতে পারি। এটা আমি মনে করব পুরোপুরি ইচ্ছা শক্তির ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি যে, জাপান, জার্মান, রাশিয়া ও চীন প্রভৃতি দেশে যেরূপ মাতৃভাষার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা হয়। তদ্রূপ অন্তত এমবিবিএস কোর্স পর্যন্ত বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা হলে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিপুলভাবে উপকৃত হবে।’

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় ও এর আন্দোলনে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের অবদান অসামান্য, দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাই

আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি ডা. আজিজুল হক বলেন, ‘আমাদের আসলে মনমানসিকতাই ইংরেজিতে গেঁথে গেছে, যেকারণে আমরা এর বিকল্প কোনোভাইবেই চিন্তা করতে পারছি না, মনে হচ্ছে, এখান  থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। এর একটা কারণ হলো আমরা দীর্ঘদিন ইংলিশ শাসনের অধীনে ছিলাম, তারপরে আবার পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম, এরপর বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধারাটা সেই একই চলছে। কাজেই ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া হোক, মন মানসিকতায় কিন্তু আমাদের এতটা পরিবর্তন আসেনি।’

শুধু কি মনমানসিকতার প্রতিবন্ধকতাই দায়ী নাকি অন্য কোন কারণ আছে- জবাবে তিনি বলেন, ‘ভাষা নিয়ে তো আসলে সবারই ভালোবাসা আছে, টান আছে। কিন্তু আমরা তো সবাই শুধু কথাই বলি, কিন্তু তেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখি না, এটাই অন্যতম সমস্যা। যেমন আমি ইচ্ছে করেই সাহস করে এগিয়ে আসলাম, আমার মতো কি আর ডাক্তার নেই? তাদেরকেও তো এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ স্যার আছেন, ওনার অনেকগুলো বাংলায় বই আছে। এমন আরও অনেককেই এগিয়ে আসতে হবে। একাডেমিক বইগুলো ইংরেজিতে লিখতে হবে।’

মেডিসিন বিভাগ, রামেক, আমাদের আসলে মনমানসিকতাই ইংরেজিতে গেঁথে গেছে, যে কারণে আমরা এর বিকল্প কোনোভাইবেই চিন্তা করতে পারছি না, মনে হচ্ছে, এখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। এর একটা কারণ হলো আমরা দীর্ঘদিন ইংলিশ শাসনের অধীনে ছিলাম, তারপরে আবার পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম, এরপর বাংলাদেশ হয়েছে।

ডা. আজিজুল হক, সাবেক বিভাগীয় প্রধান

পাঠ্যপুস্তকে দুটো ভাষাই রাখা যায় : ডা. আবু ইউসুফ ফকির

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু ইউসুফ ফকির ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘মেডিকেলের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে দুটো ভাষাই রাখা যায়। এটা চাইলেই আমরা করতে পারি। তবে পড়াতে গেলে আসলে বাংলাটা এমনিতেই চলে আসে। একটা বিষয়ে লেকচার দিতে গেলে এর মধ্যে অনেকগুলো বাংলা শব্দ চলে আসে। কোনো একটা বই পড়াতে গেলেও সেখানে অনেক বাংলা চলে আসে। সবমিলিয়ে, দুটি সুবিধা ও অসুবিধা আছে। তবে ভাষার মাস হিসেবে বাংলাকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের, তেমনই ইংরেজিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ দিনশেষে আমাদেরকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিশতে হবে, চলতে হবে এবং শিখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা তো আসলে জ্ঞান প্রযুক্তিতে এতটা আগানো না। মেডিকেল সায়েন্সে আমাদের লেখা এত বই নেই। মেডিকেলের অসংখ্য বই বিভিন্ন দেশের লেখকদের লেখা, যেগুলো আমাদেরকে পড়তে হয়। এগুলো বাংলা করতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যাবে। ফলে সঠিকটা অনেক সময় পাওয়া যাবে না, উল্টো শিক্ষার্থীরা ভুলটা শিখবে। আরেকটা বিষয় হলো, মেডিকেলের যে ইংরেজি, সেগুলো এত কঠিন না। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা সহজেই তা বুঝতে পারে।’

আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, এখানে আসলে কোনো পরিবর্তন আনা উচিত হবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানটাকে বাংলা করতে গেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক পিছিয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সেমিনার গুলোতে বাংলার কারণে তারা আটকে যাবে।

ডা. মো. আবু ইউসুফ ফকির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ইউসুফ ফকির আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে ভাষান্তর করলে করা যায়। কিন্তু মেডিকেল টার্মগুলো আসলে ঠিক থাকবে না। ইংরেজিটা শুধুমাত্র যে মেডিকেলে তা নয়, বুয়েটেও আছে, আইন শিক্ষাতেও আছে। সেক্ষেত্রে মেডিকেলে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, এখানে আসলে কোনো পরিবর্তন আনা উচিত হবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানটাকে বাংলা করতে গেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক পিছিয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক সেমিনার গুলোতে বাংলার কারণে তারা আটকে যাবে। আরেকটা সমস্যা হলো, আমাদের দেশে কিন্তু বিদেশি অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়ে। প্রতিবছর ধরেন এক থেকে দেড় হাজার বা তারও বেশি শিক্ষার্থী আমাদের দেশের মেডিকেলগুলোতে পড়তে আসে। বাংলা বই-পুস্তক হলে এই দুই হাজার ছাত্রছাত্রীর কী হবে?’

মেডিকেল শিক্ষায় বাংলা প্রেম নয় : ডা. শহীদুল্লাহ

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘মেডিকেল সায়েন্সটা আসলে বাংলা করা যাবে না। এর দুটো কারণ। প্রথমত, মেডিকেলের যত বই আছে, তার প্রায় সবই ল্যাটিন ভাষায় অথবা ইংরেজিতে। আর এই সিস্টেমটা যেহেতু গ্লোবাল সিস্টেম, যদিও চীন বা জাপানে তারা নিজেদের ভাষায় করে। কিন্তু আমাদেরকে যদি দেশে এবং দেশের বাইরে এই ডাক্তারিতে পেশাগত কাজ করতে হয়, তখন আবার বাংলায় শিখলে অসুবিধা হয়ে যাবে। যেকোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়ে চীনারা যেমন বিপদে পড়ে, আমাদেরও তেমন বিপদে পড়তে হবে। এই কারণে চীনারা আন্তর্জাতিক নানা সেমিনারেও আসে কম। জাপানিরাও তাই। সেমিনারগুলোতে তাদের কিছু আসে, যারা ইংরেজিতে জানে কিছুটা। সেজন্য এই ডাক্তারি বিদ্যাটা আমার মতে বাংলা করা যাবে না।’

এই আইডিয়াটা মাথায় আনাই যাবে না। এখানে বাংলা প্রেম করিয়ে কোনো লাভ নেই। এতে ক্ষতি ছাড়া একটুও ভালো হবে না। পড়াশোনাটা বাদ দিয়ে মেডিকেলের আরও অনেক কিছু আছে, সেগুলো বাংলায় করতে পারেন।

অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ, সভাপতি, বিএমডিসি

তিনি বলেন, ‘বাংলা করা যেতে পারে আমরা ইংরেজিতে যে প্রেসক্রিপশনটা লেখি, সেখানে ব্যবহার বিধিটা এবং ওষুধ খাবারের নিয়মটা বাংলায় লিখতে পারি। এতে করে যারা কম লেখাপড়া জানে, তাদের জন্য সহজবোধ্য হবে। সবমিলিয়ে, আমার পরিষ্কার কথা হলো, বইটাকে বাংলা করা যাবে না। আমি যখন পেশাগতভাবে রোগীর সেবা দেব, তখন বাংলায় লিখতে কোনো অসুবিধা নেই। ইতোমধ্যে আমাদের অনেকেই বাংলায় প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করেছে। যদিও সেই সংখ্যাটা অনেক কম।’

শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ইংরেজির সঙ্গে বাংলাও যুক্ত করে দেওয়া যায় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো এটা এক দিনের নয়, এটা প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাস। যদিও আমরা বাংলায় কথা বলি, এসএসসি-ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বাংলায় পড়াশোনা করি, তারপরও কিন্তু ডাক্তারি পড়ায় ঢোকার পরে ইংরেজি বুঝতে কিন্তু কোনো ধরনের অসুবিধা হয় না। ভেরি ইন্টারেস্টিং। বুঝতে অসুবিধা হয় না কারণ, মেডিকেলের পড়াশোনাটা কিন্তু এত বেশি কঠিন ভাষার নয়। আমরা কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যও বুঝতে পারি না, কিন্তু মেডিকেলের বই সহজেই বুঝতে পারি। ফলে এটার আর বাংলা করার কোনো প্রয়োজন নেই। যেটা করতে পারে, সেটা হলো নার্স-মিডওয়াইফদের জন্য যে কারিকুলাম, সেখানে যে আমরা প্রশিক্ষণ মেটারিয়াল তৈরি করি, সেগুলো যদি বাংলায় করা হয়, তাহলে নার্সদের জন্য বুঝতে সুবিধা হয়, কিন্তু ডাক্তারদের আবার এগুলো সমস্যা হয় না।’

মাতৃভাষা হিসেবে কিছু বই বাংলায় করা যায় কি-না- জবাবে ডা. শহীদুল্লাহ আরও বলেন, ‘এই আইডিয়াটা মাথায় আনাই যাবে না। এখানে বাংলা প্রেম করিয়ে কোনো লাভ নেই। এতে ক্ষতি ছাড়া একটুও ভালো হবে না। পড়াশোনাটা বাদ দিয়ে মেডিকেলের আরও অনেক কিছু আছে, সেগুলো বাংলায় করতে পারেন। অনেক চিকিৎসকই নানা পরামর্শমূলক বিভিন্ন বই বাংলাতে লিখে থাকেন, এমনটা হতে পারে। কিন্তু একাডেমিক কোনো বই বাংলা করাই যাবে না।’

টিআই/এফআর