মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর মহুয়া লেয়া ফলিয়া বলেছেন, গণমাধ্যমে নারীদের অভিবাসন নিয়ে বেশিরভাগ খবর নেতিবাচক। ইতিবাচক খবর কম দেখতে পাই। অভিবাসী নারীদের প্রতি শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতে হবে। এ বিষয়ে একটি শব্দ ভাণ্ডার তৈরি করা প্রয়োজন।

মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ আয়োজিত অভিবাসী নারী শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইসিএমপিডির কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মাদ ইকরাম হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদে নারী অভিবাসন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। ডেমো অফিসকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং নারী-বান্ধব করা প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন সুবিধা আছে, সরকার নতুন পলিসির উদ্যোগ নিচ্ছে যেমন রিইন্টিগ্রেশন পলিসি। একদম ডোর স্টেপে সার্ভিসগুলো প্রচার করতে হবে।

সিডব্লিউসিএস এর সভাপতি প্রফেসর ইসরাত শারমিন বলেন, স্থানীয় সরকারকে অভিবাসনের সব তথ্য জানতে হবে। অভিবাসী নারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে হবে। দেশের বাইরে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে তারা তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস কিভাবে সংরক্ষণ করতে পারে তা শিখাতে হবে। সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ অভিবাসন খাতের তথ্য আনা জরুরি। 

এ সময় নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক রীতা ভৌমিক। তিনি বলেন, বিএমইটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯১ সাল থেকে ২০২২ এর মে মাস পর্যন্ত ১,০৫০,৮১৯ জন নারী বিদেশে গিয়েছেন। এ সংখ্যক নারীর সবাই নির্যাতনের শিকার হয়নি। তার মধ্যে কিছু সংখ্যক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জানুয়ারি ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত আমরা মিডিয়া স্ক্যান করে দেখেছি, বেশিরভাগ মিডিয়া নেতিবাচক কেসগুলো উত্থাপন করছে। আমরা দেখতে পাই, যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে বেশিরভাগই তাদের কেস স্টোরি। কিন্তু কিভাবে তারা যাবে, কোন সেবা কেন্দ্র থেকে কি ধরনের তথ্য পাবে, তা মিডিয়াতে কম প্রচার হয়। আমরা প্রত্যাশা করি, মিডিয়া সম্পূর্ণ অভিবাসন খাতের তথ্য জানাবে।

এ সময় তিনি গণমাধ্যমের রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। সুপারিশ সমূহ হলো :

১. মাসব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু থাকলেও অনেকে তা ঠিকমতো নেন না। রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে আবাসিক প্রশিক্ষণ না নিয়েই প্রবাসে চলে যায়। দালালরাও তাদের সত্য কথা বলে না। দালালদেরও শনাক্ত করতে হবে। 

২. দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সির পাশাপাশি এ দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে কারিগরি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো যুক্ত আছে কি না তা যাচাই করতে হবে।

৩. সামাজিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে অপরাধী যাতে শাস্তি পায় এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

৪. অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সঠিক ডাটাবেজে নাম নিবন্ধন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা দরকার।

৫. রিক্রুটিং এজেন্সি কাদের পাঠাচ্ছে, কি কাজে পাঠাচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ নিচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে মনিটরিং করতে হবে। 

৬. অভিবাসী নারী শ্রমিকদের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের আইন ও নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক বরাদ্দ থাকা দরকার। 

৭. রিক্রুটিং এজেন্সির অভিবাসন আইন ও নীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। যাতে তারা অভিবাসী নারী শ্রমিকের নিরাপত্তা, অধিকার, ইমিগ্রেশন পদ্ধতির বিষয়ে নিজস্ব কৌশলগত দিক উন্নত করতে পারে।

৮. রিক্রুটিং এজেন্সির বৈধতা জানতে বিএমইটি ও ডিইএমও অফিসে যোগাযোগ করা।

৯. সব আর্থিক লেনদেনের লিখিত রশিদ গ্রহণ এবং সংরক্ষণ। 

১০. টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে বিএমইটি থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র গ্রহণ এবং বিএমইটি হতে ভিসার সত্যতা ও মেয়াদ যাচাই।

১১. বিমানে ওঠার আগে পাসপোর্ট, ভিসা ও চাকরি সংক্রান্ত সব কাগজপত্র সঙ্গে নেওয়া। 

১২. অনুমোদিত চিকিৎ‍সা সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সনদ ও চুক্তিপত্র যাচাই (বেতন ভাতা, আহার, বাসস্থান, ছুটি, ওভারটাইম, চিকিৎসা) রিপোর্ট নেওয়া।

১৩. নারী অভিবাসী শ্রমিকদের সব চুক্তির ক্ষেত্রে, মানবাধিকার, নারীবান্ধব মানসম্পন্ন শর্তসাপেক্ষ কি না সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই করে দু দেশেই সংরক্ষণ করা।

১৪. একটি নিরাপদ, সুষ্ঠু, সুন্দর ও সর্বোৎকৃষ্ট অভিবাসনের জন্য সরকার, রিক্রুটিং এজেন্সি, উন্নয়ন সহকারী, স্টেক হোল্ডার এবং সুশীল সমাজের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।

১৫. দূতাবাসে তথ্য আপা প্রোজেক্ট থাকা।

১৬. অভিবাসীদের বাড়ি বাড়ি যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগী শনাক্তকরণ, মূল্যায়ন (মনোসামাজিক দুর্বলতা এবং আর্থিকপ্রয়োজনের মূল্যায়ন) ও নির্বাচন। 

১৭. প্রত্যাবর্তনকারী নারী অভিবাসীদের অভিবাসন সময়ে সংঘটিত নানা রকম মানসিক আঘাত লাঘব করতে যথাযথ গোপনীয়তা বজায় রেখে মনোসামাজিক কাউন্সিলিং করা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। 

১৮. স্থানীয় নেতাদের সহযোগিতায় ও মধ্যস্থতায় নারী অভিবাসীদের অভিবাসনকালীন ঋণ পরিশোধে সহযোগিতা।

১৯. প্রত্যাবর্তনকারী নারী অভিবাসীদের সেলাই, পশুপালন বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং প্রশিক্ষণ শেষে চাকরির ব্যবস্থা করা। ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া।

২০. অভিবাসীকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয় হিসেবে সমাজে গ্রহণ করা। শ্রমবাজারে সব ধরণের কাজে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা। সমাজের প্রতি সব দায়িত্ব এবং কর্তব্য সমানভাবে পালন।

আইবি/আইএসএইচ